বিএনপির মহাসমাবেশ: ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে তল্লাশি, চেক করা হচ্ছে মুঠোফোন
বেলা ৩টা ৩০ মিনিট। রাজধানীর ধউর বেড়িবাঁধ মোড়ে তল্লাশিচৌকিতে দাঁড়িয়ে আছেন ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ সদস্য। সবাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মোটরসাইকেল আসতে দেখলেই দূর থেকে ইশারা দিয়ে গতি রোধ করছেন। গাড়ি থামাতেই ঘিরে ধরে শুরু করছেন তল্লাশি।
সাভারের ইপিজেড এলাকা থেকে আলিফ পরিবহনের কটি বাস এসে থামল তল্লাশিচৌকির সামনে। বাসটি মহাখালী বাস টার্মিনাল হয়ে যাবে মিরপুরে। পুরো বাসে ৩০ থেকে ৪০ জন যাত্রী। এর মধ্যে তিন-চারজন পুলিশ সদস্য বাসে উঠে ‘নাম কী, যাবেন কোথায়, ব্যাগে কী, পরিচয়পত্র আছে কি না’ ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জেরা করতে থাকেন যাত্রীদের। একপর্যায়ে শুরু করেন মুঠোফোন তল্লাশি। বিরক্ত হয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান কোনো কোনো যাত্রী।
২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এভাবেই ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। মুঠোফোন তল্লাশি করায় কেউ কেউ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তাঁরা বিষয়টিকে ‘হয়রানি’ বলছেন।
তবে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাঁরা তল্লাশিচৌকি বসিয়েছেন।
ধউর বেড়িবাঁধ মোড়
ঢাকা-আশুলিয়া ও মিরপুর-আবদুল্লাহপুর সড়ক এসে যুক্ত হয়েছে ধউর বেড়িবাঁধ মোড়ে। প্রায় আধঘণ্টা অবস্থান করে পুলিশকে তল্লাশি কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়। দুই দিক থেকে কোনো মোটরসাইকেল বা যাত্রীবাহী বাস আসতে দেখলেই পুলিশ গতি রোধ করে তল্লাশি করে। এ সময় কোনো কোনো যাত্রী-পথচারীর হাতে বড় ব্যাগ থাকলে ব্যাগ খুলে খুলে তল্লাশি করে পুলিশ। এ সময় অনেকের মুঠোফোন তল্লাশি করা হয়।
ওবায়দুল ইসলাম একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, ‘পুলিশ গাড়িতে উঠেই নানা প্রশ্ন শুরু করে। একটা একটা করে ব্যাগ তল্লাশি করে। একপর্যায়ে আমার মোবাইল তাদের হাতে দিতে বলে। মোবাইল একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস দেওয়া যাবে না বলায় তারা আমার সঙ্গে তর্ক শুরু করে। আমিও কথা ধরি। একপর্যায়ে এক কর্মকর্তার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত আমার মোবাইল চেক করেনি। চলতি পথে এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই বিব্রতকর।’
তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্বরত তুরাগ থানার উপপরিদর্শক মো. পাবেল হোসেন বলেন, এটা পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম। নাশকতা রুখতে পুলিশের এই তৎপরতা। মুঠোফোন তল্লাশির বিষয়ে বলেন, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে যাত্রীদের সাময়িক কিছুটা ভোগান্তি হতে পারে। তবে এটা বড় কোনো বিষয় নয়।
কামারপাড়া মোড়
ধউর বেড়িবাঁধ থেকে ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক ধরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সামনে এগোলে কামারপাড়া মোড়। রাজধানীর আরেকটি প্রবেশদ্বার। গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একটি শাখা সড়ক এখানে এসে যুক্ত হয়েছে। যে কেউ এই সড়ক দিয়ে গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারেন। একইভাবে আরেকটি সড়ক সাভারের আশুলিয়ার দিকে গেছে। ওই সড়ক ধরে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ রাজশাহী বিভাগের মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেন।
বিকেল চারটার দিকে কামারপাড়া মোড়ে গিয়ে পুলিশের তল্লাশিচৌকি দেখা যায়। কোনো যানবাহন আসতে দেখলেই পুলিশ গতি রোধ করে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। চলতি পথে পুলিশের এমন তৎপরতা দেখে প্রায় সবাই বিরক্ত। ক্ষোভ ধরে রাখতে না পেরে কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ছিলেন।
গাজীপুরের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন মো. শাহ আলম। কলেজের কাজ শেষে একটি প্রাইভেট কারে তিনি রাজধানীর উত্তরায় ফিরছিলেন। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে তাঁর গাড়িটি কামারপাড়া মোড়ে আসতেই চারদিক থেকে ঘিরে ধরে পুলিশ। শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষক মানুষ। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। কোনো সভা-সমাবেশেও যাই না। তারপরও গাড়ি থেকে নামিয়ে আমার দেহসহ পুরো গাড়ি তল্লাশি করেছে। পুলিশের তৎপরতা দেখে মনে হয়, দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। এটা মানুষের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
কামারপাড়া মোড়ে দায়িত্বরত উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক পার্থ প্রতীম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই এই কার্যক্রম। এটা সব সময় থাকে। এখানে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে না।
আবদুল্লাহপুর মোড়
কামারপাড়া মোড় থেকে একই সড়ক ধরে আরও দুই কিলোমিটার সামনে এগোলে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর মোড়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকামুখী সড়কের পলওয়েল কারনেশনের ঠিক সামনে র্যাবের বিশেষ তল্লাশিচৌকি। সড়ক ও সড়কের পাশে অবস্থান করছেন ১০ থেকে ১২ জন র্যাব সদস্য। যানবাহন বা পথচারীদের কাউকে দেখলে ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-আশুলিয়া সড়ক এসে যুক্ত হয়েছে আবদুল্লাহপুর মোড়ে। এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেন।
তল্লাশির বিষয়ে নাম প্রকাশ করে র্যাবের কোনো সদস্য বক্তব্য দিতে রাজি হননি। র্যাবের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এটা র্যাবের নিয়মিত কার্যক্রম। বেলা তিনটার পর তল্লাশি শুরু হয়েছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটানোর পাঁয়তারা করছেন কি না, তা দেখতে তাঁরা সড়কে অবস্থান করছেন। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
চন্দ্রা ত্রিমোহনী মোড়
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় তল্লাশিচৌকি বসিয়ে উত্তরবঙ্গ, তথা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দিয়ে রাজধানীমুখী বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালায় পুলিশ। যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেট কার থামিয়ে তারা কাগজপত্র দেখছে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দেহ তল্লাশি করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চন্দ্রা ত্রিমোড় থেকে গাজীপুরের দিকে ভোগড়া পর্যন্ত যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। হঠাৎ দু-একটি যাত্রীবাহী বাস দেখা গেলেও তেমন যাত্রী ছিল না। চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের গাজীপুর জেলার ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য একটি বাস থামিয়ে বাসের কাগজপত্র যাচাই করছেন।
চন্দ্রা এলাকায় ক্রাউন ডিলাক্স পরিবহনের সহযোগী মো. কবির মিয়া বলেন, রাস্তায় কয়েকটি গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করেছে। রাস্তায় অন্য দিনের চেয়ে একেবারেই গাড়ি কম। দেখে মনে হচ্ছে, হরতাল-অবরোধ চলছে। দায়িত্বরত সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চন্দ্রায় প্রতিদিনই যানবাহনের কাগজপত্র যাচাই করা হয়। তারই অংশ হিসেবে আজ বিকেলেও করা হয়েছে। এটা আমাদের নিয়মিত কাজ, নতুন কিছু নয়।’
কাল শনিবার ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আজ বিকেল থেকেই বিভিন্ন সড়কে তল্লাশিচৌকি বসান পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। বিশেষ করে ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে কড়া তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সন্দেহভাজন কাউকে পেলে তাঁকে আটকও করা হচ্ছে।