কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচারদ্বীপ সমুদ্রসৈকত-লাগোয়া পরিবেশবান্ধব ইকোট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান মারমেইড বিচ রিসোর্ট। গত বুধবার থেকে রিসোর্টের আঙিনায় শুরু হয় তিন দিনব্যাপী বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল। গতকাল শুক্রবার শেষ দিনে উৎসব ছিল বেশ জমজমাট। পরিবেশিত হয় হালের জনপ্রিয় ডিজে এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের নৃত্য ও বাউল গান। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় মুগ্ধ হন পর্যটকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক রক সিটির বার্নিং ম্যান প্রজেক্টের আদলে মারমেইড বিচ রিসোর্টের এ আয়োজন সাজানো হয়। উৎসবের কিউরেটর হিসেবে যুক্ত ছিলেন খ্যাতিমান জাপানি ফেস্টিভ্যাল আর্কিটেক্ট এবং লাইটিং ডিজাইনার জিরো এন্দো। ডিজে পরিবেশন করেন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জাপান থেকে আসা শিল্পীরা।
গতকাল রাত ১১টা। মারমেইড বিচ রিসোর্টের পশ্চিম পাশের সৈকতঘেঁষা বালুচরে স্থাপিত ডিম আকৃতির ‘এগ প্লানেট’ মঞ্চে ডিজে পরিবেশন করছিলেন থাইল্যান্ড থেকে আসা তরুণী শিল্পী নিপাংকু। দুই শতাধিক তরুণ-তরুণী ডিজের তালে নাচে ব্যস্ত। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সমুদ্রের পানিতে ভাসমান ১১টি ডিঙি নৌকার সমন্বয়ে শুরু হয় দৃষ্টিনন্দন বোট শো। বালুচরে চলে—ফায়ার শো। আতশবাজির সঙ্গে ডিজে ফায়ার শো এবং বোট শো মিলে ভিন্ন রকমের আমেজ তৈরি হয় উৎসবে। এর আগে একই মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক শ পর্যটক সানসেট ও মুন পার্টি উপভোগ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যালের জন্য রিসোর্টের আঙিনায় সাজানো হয় পৃথক পাঁচটি মঞ্চ। রিসোর্টের পশ্চিম পাশের খোলা মাঠে নির্মিত কাঁকড়া মঞ্চে সন্ধ্যায় চলে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের বোতলনৃত্য, মারমাদের জুমনৃত্য, রাখাইনদের ছাতানৃত্য ও ম্রোদের বাঁশনৃত্য। রাত ৯টা থেকে একই মঞ্চে শুরু হয় ডিজে পার্টি। পশ্চিম পাশে সমুদ্রের পানিতে নির্মিত ‘মিস্টিক বাউল’ মঞ্চে চলে বাউল ও লালন শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনা। রিসোর্টের দক্ষিণ পাশে ক্র্যাব ড্রিমার, কসমিক টার্টল ও বিগ ব্যাঙ নামে আরও তিনটি পৃথক মঞ্চে রাত তিনটা পর্যন্ত চলে ডিজের সঙ্গে নাচানাচি, আড্ডা ও রকমারি খাবারের আয়োজন। গভীর রাত পর্যন্ত জাপান, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, স্পেন, ভিয়েতনাম, নেপাল, ভুটান, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১১টি দেশ থেকে ভ্রমণে আসা শতাধিক পর্যটক ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করেন। বিদেশি শিল্পীরা ডিজে পরিবেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সংগীত উপভোগ করেন।
‘এগ প্লানেট’ মঞ্চের ডিজে পরিবেশন শেষে থাইল্যান্ড থেকে আসা শিল্পী নিপাংকু কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। থাইল্যান্ডে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত এই তরুণী শখের বশে ডিজে শিখেছেন। সময় সুযোগ হলে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন ডিজেতে অংশ নেন তিনি। মারমেইডের এই উৎসব তাঁকে বেশ আকৃষ্ট করেছে দাবি করে নিপাংকু বলেন, কাঁকড়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনিসহ অনেক শিল্পী ও বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের নাচগান উপভোগ করেছেন। থাইল্যান্ডেও এ ধরনের নাচগান হয়, কিন্তু এটি ব্যতিক্রম। রাতের অন্ধকারে রঙের খেলার সঙ্গে সাগর-পাহাড়ের সম্মিলন উৎসবের আমেজ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাত ১২টায় কাঁকড়া মঞ্চে ডিজে পরিবেশন শেষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন স্পেনের তরুণ শিল্পী পাসলু বাস। তাঁর ডিজেতে মজেন বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা। পাসলু বাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি ডিজে পরিবেশন করেন। কিন্তু তাঁর কাছে মারমেইড এই ফেস্টিভ্যাল ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এখানকার মানুষগুলো অনেক ভালো। একসঙ্গে আনন্দ করতে জানেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সমুদ্রের তীর এবং পাহাড়ের সম্মিলনে নিরিবিলি পরিবেশের এমন ফেস্টিভ্যাল পৃথিবীর কোথাও হয় না। পাসলু বাস আরও বলেন, তিনি ডিজে পরিবেশন করে যতটুকু খুশি, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন বাংলাদেশিদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে। ভবিষ্যতে মারমেইডের ফেস্টিভ্যালে তাঁকে ডাকলে তিনি অবশ্যই সাড়া দেবেন।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কাঁকড়া মঞ্চে বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের রাখাইন, ম্রো, মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, পাংখোয়া সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন নৃত্য–গান উপভোগ করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়ে এই ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। বাংলাদেশে যত গোষ্ঠী আছে সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশ। এই বহুত্ব জাতীয়তাবাদী চিন্তাটা আমরা বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে চাই। বিদেশিদের কাছে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চাই—বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের না, হিন্দুদের না, বৌদ্ধদের না, সবার।’
উৎসবে জাপান থেকে আসা একজন তরুণী বলেন, সমুদ্রতীরের এই ফেস্টিভ্যাল তিনি সুন্দরভাবে উপভোগ করছেন, নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। পাহাড়ি তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নাচগান এবং সাদা পোশাকে বাউল পরিবেশনায় মুগ্ধ তিনি। গানের ভাষা না বুঝলেও তিনি বেশ উপভোগ করেছেন।
বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যালের আয়োজক মারমেইড ইকোট্যুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ব্যতিক্রমী এই ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। ১১টি দেশের শতাধিক পর্যটকসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা দুই হাজার নারী-পুরুষ উৎসব উপভোগ করেছেন। সমুদ্রতীরে নিরিবিলি পরিবেশে উৎসবের ভেন্যু হওয়াতে সবাই আনন্দ-উল্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ তিন দিন দ্বিতীয় বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হবে।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প ও সংস্কৃতি উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বার্নিং ম্যান’ উৎসবটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক রক সিটির মরুভূমিতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পী, উদ্যোক্তা এবং দর্শকেরা একত্রিত হন। সৃজনশীলতা, মুক্ত পরিবেশ এবং স্বাধীনতা—এগুলোই হচ্ছে উৎসবের মূলমন্ত্র। একই আদর্শে আয়োজিত হয়েছে কক্সবাজারের বার্নিং ক্র্যাব ফেস্টিভ্যাল।