স্বামীর পর সন্তানকে হারানো জরিনা বললেন, কিসের আশায় বাঁচব, কাকে নিয়ে বাঁচব

স্বামীকে হারিয়েছেন প্রায় ১৬ বছর আগে। এবার সড়ক দুর্ঘটনায় হারালেন একমাত্র সন্তানকেও। সব হারিয়ে এখন একা জরিনা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

‘আমার পাখি উড়ে গেছে। দুনিয়ায় আমার আর কিছু থাকল না। কিসের আশায় বাঁচব, কাকে নিয়ে বাঁচব আমি।’ আজ শনিবার বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া এলাকায় ঘরের বারান্দার খাটে বসে এভাবে বিলাপ করছিলেন মো. বাদশা শেখের (১৭) মা জরিনা বেগম।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা এলাকায় বাসচাপায় নিহত হয় বাদশা শেখ নামের ওই কিশোর। সে বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জ মালোপাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত দবির উদ্দিনের ছেলে। পড়ত বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ রসিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে।

১৮ মাস বয়সে বাবাকে হারায় বাদশা। সাংসারিক জটিলতা থাকায় একমাত্র সন্তান বাদশাকে নিয়ে নিজের বাবার বাড়ির পাশে পালপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকতেন বিধবা জরিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পরে কলিজার টুকরা বাদশাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। অনেক কষ্ট করে বাদশাকে বড় করেছি। বাদশা ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ওকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়েও করিনি। বাদশা সব সময় বলত, “এসএসসি পাস করলেই তোমার আর কষ্ট হবে না। পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে আমার চাকরি হয়ে যাবে। তখন তুমি শুধু শান্তি করবা।” আমার বাবা একবারে পাস করে গেছে, এখন তাকে নিয়ে আমার আর কষ্ট হবে না’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জরিনা বেগম।

শুক্রবার বিকেলে নছিমনে করে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যাটারিংয়ের কাজে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হয় মো. বাদশা শেখ। দুর্ঘটনায় নছিমনে থাকা ১৮ জনের মধ্যে বাদশাসহ পাঁচজন নিহত হয়।

নিহত অন্য ব্যক্তিরা হলো বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামের আল আমিন মল্লিকের ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মল্লিক (১৭), মাঠ রাঢ়িপাড়া এলাকার আবদুল কাদের মোল্লার ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মোল্লা (১৮), মোরেলগঞ্জ উপজেলার চোমড়া এলাকার মো. হালিম শেখের ছেলে মো. সাব্বির শেখ (১৬), একই এলাকার আবুল মিনার ছেলে ইয়াসিন মিনা (১৬)। সাব্বির গোয়ালমাঠ রসিক লাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে এবং ইয়াসিন মিনা যদুনাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে পড়ে। এ ছাড়া এই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সিরাজুল ইসলাম শিমুল, অনিক দত্ত ও বনি আমিন নামের তিন তরুণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার বিকেলে নিজ নিজ বাড়িতে নিহত কিশোরদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।

নিহত শাহিন মল্লিক চলতি বছর গোয়ালমার রসিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। তাঁর মা পেয়ারা বেগম বলেন, ‘নৌবাহিনীতে আবেদন করেছিল আমার বাবা শাহিন। বাবার চাকরির স্বাদ আর মিটল না। কোনো মায়ের সন্তান যেন নছিমনে না ওঠে’—বলে বিলাপ করতে থাকেন তিনি।

একমাত্র ভাইকে হারিয়ে কান্না থামছে না নিহত শাহিন মোল্লার ছোট দুই বোনের। শাহিনের বোন সেঁজুতি আক্তার বলে, ‘আমরা দুই বোন এক ভাই। শাহিন ভাই-ই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। শোনার পর থেকেই আব্বা ও মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কোনো কথাও বলছেন না। কী হবে আমাদের?’ এই বলে আবারও কান্না শুরু করেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সেঁজুতি আক্তার।

এদিকে পাশাপাশি এলাকায় পাঁচ কিশোরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে। মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পার হলেও নিহত কিশোরদের পরিবারকে সরকার ও ক্যাটারিং কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। তাদের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ইকবাল মোল্লা বলেন, ‘যারা মারা গেছে, তাদের সবার পরিবারই অসহায়। মাত্র এক শ টাকার জন্য ওরা ক্যাটারিং সার্ভিসে কাজ করতে গিয়েছিল। এক শ টাকা আয় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তারা। এসব পরিবারকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানাই আমরা।’

কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, নিহত কিশোরদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। স্বজনহারা এই পরিবারগুলোর পাশে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থাকবে। এ বিষয়ে আইনের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।