হাত ধরে টেনেও সাড়া না মেলায় ছোট্ট আয়শা বলে, বাবা ঘুমাচ্ছে
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় যখন বাড়ির উঠানে ছোট্ট নুর আয়শার বাবার নিথর দেহ রাখা হয়, তখন সে বাবার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। বাবার সাড়া না পেয়ে চার বছরের শিশুটি মাকে বলে, বাবা ঘুমাচ্ছে। রাতেও বিছানায় বাবাকে খুঁজতে থাকে সে। আজ রোববার সকাল থেকে মুখে খাবার তুলতে চাইছে না। তার একটাই কথা, বাবা এলে তাঁর হাতে খাবে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা জানান নুর আয়শার মা জান্নাত আরা বেগম (২৫)। গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ের ১২ নম্বর ব্রিজ এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বাসের সঙ্গে একটি লেগুনার সংঘর্ষে প্রাণ হারান পাঁচজন। তাঁদের একজন মো. হামিদুল্লাহ (৩০) নুর আয়শার বাবা। তিনি চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের কলাতলী এলাকার আবুল বাছেরের ছেলে। পাহাড়ের সংরক্ষিত ভূমিতে ঘর করে থাকে পরিবারটি।
মো. হামিদুল্লাহর স্ত্রী জান্নাত আরা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে কাজে বের হওয়ার আগে ওর বাবা মেয়েকে (নুর আয়শা) বাড়ির পাশের দোকানে নিয়ে গিয়ে নাশতা কিনে দিত। এ কারণে সকাল থেকে বাবাকে খুঁজছে সে। অন্য কেউ নাশতা এনে দিলেও খাচ্ছে না। তার বাবা যে আর কোনো দিন নাশতা দেবে না, এ কথা আমার ছোট্ট মেয়েটা কেমনে বুঝবে?’
হামিদুল্লাহর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ওসমান গনি (৭) স্থানীয় একটি হেফজখানায় পড়ছে। চার বছর বয়সী নুর আয়শাকে এখনো কোথাও ভর্তি করা হয়নি। সবার ছোট ইসমাইল গনির বয়স তিন মাস।
কলাতলী এলাকার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির দেয়ালের টিনশেড ঘরের সামনে হামিদুল্লাহর বড় ছেলে ওসমান গনি খেলা করছে। মেয়ে নুর আয়শা খাবার খেতে চাইছে না। সে বাবাকে খুঁজছে আর কান্নাকাটি করছে। এক ব্যক্তি চিপস এনে দিলেও তা নেয়নি ছোট্ট এ শিশু। তার এক কথা, বাবার হাতে ছাড়া সে কিছুই খাবে না।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, দিনমজুর হামিদুল্লাহর বাবা আবুল বাছের (৭৪) ও মা লাইলা বেগম (৬৫) ছেলের সঙ্গেই থাকতেন। তাঁদের অন্য চার সন্তান পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন।
হামিদুল্লাহ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জানিয়ে তাঁর স্ত্রী জান্নাত আরা বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে সংসার চালাত আমার স্বামী। দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল। এখন ছোট্ট তিন শিশুসন্তান নিয়ে কার দরজায় গিয়ে দাঁড়াব? তাদের খোরপোশ জোগাড় করব কীভাবে?’
গতকাল সকালের এ দুর্ঘটনায় নিহত অন্যরা হলেন চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের কলাতলী এলাকার মৃত লাল মিয়ার ছেলে মো. জাহাঙ্গীর আলম (২০), মৃত ছিদ্দিক আহমদের ছেলে মো. রাসেল (৪০), করম মুহুরী পাড়ার মৃত দানু মিয়ার ছেলে নজরুল ইসলাম (৩৪) ও হারবাং আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার মো. সরওয়ার আলমের মেয়ে নারগিস আকতার (১৫)।
এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের বাড়িই কলাতলী এলাকায় হওয়ায় পুরো এলাকা শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে। স্থানীয় মোহাম্মদ আইয়ুব (৩৫) বলেন, তিনজনই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ভালো মানুষগুলোকে আল্লাহ তাআলা আগে নিয়ে যান।
হামিদুল্লাহর বাড়ির পাশেই নিহত জাহাঙ্গীর আলমের (২০) বাড়ি। পাঁচ বছর আগে তাঁর বাবা লাল মিয়া মারা যান। এরপর মা, তিন বোন ও এক ভাই তাঁর আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলমের মা আয়েশা বেগম (৪০) ছেলের শোকে বুক চাপড়ে বলেন, ‘আমাগোর দেখার আর কেউ রইল না।’
এ দুই বাড়ির কাছেই নিহত মো. রাসেলের বাড়ি। তাঁর ভাইয়েরা সবাই কক্সবাজারের ঝিলংজায় থাকেন। এক দশক ধরে রাসেল হারবাংয়ের কলাতলী এলাকার পাহাড়ে ঘর করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকছিলেন। রাসেলের চার মেয়ে ও এক ছেলে। সন্তানদের নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী।