রোজায় পানি পাওয়া নিয়ে দুর্ভাবনা

স্বাভাবিক সময়ে ওয়াসার পানির ঘাটতি থাকে ৫ কোটি লিটার। নদীর পানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি লিটারে।  

নগরে ওয়াসার পানির সংকট। দূরদূরান্ত থেকে তাই পানি সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের। সম্প্রতি নগরের সাগরিকা এলাকায়ছবি: জুয়েল শীল

‘বাসায় নিয়মিত পানি আসে না। কখনো সপ্তাহে তিন দিন পাই। কখনো দুই দিন। ফলে দূরদূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করতে কিংবা কিনতে হয়। রোজায় কলসি ভরে পানি টেনে আনার মতো অবস্থা থাকে না। তাই প্রতিদিন অন্তত একবার পানি চাই।’

চট্টগ্রাম নগরের আকবরশাহ এলাকার বাসিন্দা জোবায়দা আখতার পানি সরবরাহ নিয়ে এসব কথা বললেন। গত শুক্রবার দুপুরে চল্লিশোর্ধ্ব এই গৃহিণীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সেমিপাকা একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। তাঁর স্বামী সাইফুল ইসলাম পোশাকশ্রমিক। জোবায়দা জানান, পাঁচটি সেমিপাকা ঘর রয়েছে তাঁদের কলোনিতে। ভাড়া দিতে হয় ছয় হাজার টাকা করে। মাসে পানির জন্য বাড়তি আরও হাজার দেড়েক টাকা খরচ হয়। অন্তত এই রোজায় নিয়মিত পানি চান তিনি।

শুধু আকবরশাহর বাসিন্দা জোবায়দা নন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার মানুষ রোজার মাসে প্রতিদিন অন্তত একবার করে ওয়াসার পানি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে উত্তর হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, ইপিজেড, আগ্রাবাদ, বায়েজিদ, লালখান বাজার, বহদ্দারহাট, অক্সিজেন, আন্দরকিল্লা। উৎপাদন কম হওয়ার কারণে দুই মাস ধরে এসব এলাকায় পানির সংকট তীব্র হয়েছে। কিন্তু এসব এলাকায় পানি সরবরাহে ওয়াসার পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন গ্রাহকেরা।

ওয়াসা বলছে, কাগজে-কলমে বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। ফলে ঘাটতি থাকে প্রতিদিন ৬ কোটি লিটার। হালদা ও কর্ণফুলী নদী থেকে আসে উৎপাদনের ৯২ শতাংশ পানি ও গভীর নলকূপ থেকে পাওয়া যায় ৮ শতাংশ পানি। কিন্তু এক মাস ধরে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় সরবরাহেও বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন গড়ে পাঁচ কোটি লিটার করে কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ঘাটতি পৌঁছেছে ১১ কোটি লিটারে।

সংস্থাটির প্রকৌশলীরা বলছেন, রোজায় পানির চাহিদা আরও অন্তত দুই কোটি লিটার বেড়ে যায়। রোজার মাসে চারটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও সাতটি দল গঠন করা হয়েছে। গভীর নলকূপগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসবের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হবে। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, ওয়াসার এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। প্রতিবছর রোজাতেই এ রকম কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু দিন শেষে সরবরাহে ঘাটতি থেকে যায়।

জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, নদীর পানি কমে যাওয়া, শেওলা ও লবণের কারণে উৎপাদন কম হচ্ছে। তবু রোজায় সরবরাহ ঠিক রাখতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ছয়টি পানিবাহী গাড়ি প্রস্তুত থাকবে। গভীর নলকূপও চালু রাখা হবে।

পরিকল্পনায় ঘাটতি

নগরের পাথরঘাটা এলাকায় এমনিতেই ওয়াসার পানির সংকট। ওই এলাকার বাসিন্দারা নিয়মিত পানি পান না। এখন উৎপাদন কমে যাওয়ায় সংকট আরও তীব্র হয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা রফিকুল আলমের ভবনে গত দুই দিনে মাত্র একবার পানি পৌঁছেছে। বাধ্য হয়ে তিনি কেনা পানিতে কাজ সারছেন। রফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, পানির সংকটে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে পর্যাপ্ত পানি না পেলে ভোগান্তি আরও বাড়বে।

জানা গেছে, নগরের ওয়াসার পানির সংকটে রয়েছেন ২০ এলাকার ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ। কোনো এলাকায় দুই দিনে একবারও পানি যাচ্ছে না। কোথাও ঘণ্টাখানেকের জন্য পানি থাকছে। কর্ণফুলী নদীতে পানি কমে যাওয়া ও শেওলা বাড়ার কারণে উৎপাদন কমে গেছে।

সংস্থাটির তথ্যমতে, স্বাভাবিক সময়ে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার ১ ও ২ থেকে আসে ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার। এ ছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি। কর্ণফুলী পানি শোধনাগার ১ ও ২ থেকে বর্তমানে প্রতিদিন তিন কোটি লিটার পানি কম আসছে। দুটি শোধনাগার থেকে পানি মিলছে গড়ে ২৫ কোটি লিটার। অর্থাৎ পানি মিলছে ৪৪ থেকে ৪৫ কোটি লিটার।

বায়েজিদ এলাকার বাসিন্দা গোলাম সরওয়ারের পাঁচতলা ভবন। ওয়াসার সংযোগের পাশাপাশি তাঁর বাড়িতে গভীর নলকূপ রয়েছে। গোলাম সরওয়ার জানান, ওয়াসার লাইনে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলছেন। প্রতিদিন অন্তত তিনবার পানি তুলতে হয়। এতে বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ওয়াসার পানি পাওয়া গেলে এই খরচ কম। মোটরও কম ব্যবহার করতে হতো।

পাহাড়তলীর ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা মোস্তাফিজুল কবিরের চারতলা ভবন। ৯ পরিবারের বাস সেখানে। সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এক ঘণ্টা পানি পেয়েছেন। জলাধারের চার ভাগের এক ভাগও পূরণ হয়নি। এতে ভাড়াটেসহ তিনি খুব কষ্টে আছেন। রোজায় এমন অবস্থা চলতে থাকলে কী হবে, তা তিনি ভাবতে পারছেন না।

পানি সরবরাহে ওয়াসার পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি না পেয়ে অনেকেই অভিযোগ করছেন। কিন্তু ওয়াসার পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি পানিবাহী গাড়ি, চারটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ দিয়ে ভোগান্তি দূর করা যাবে না। ৪১ ওয়ার্ডের জন্য অন্তত ১৫টি গাড়ি, প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য একটি করে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা উচিত। এ ছাড়া সংকটে থাকা এলাকা চিহ্নিত করে পানি সরবরাহের পরিকল্পনা নিতে পারত সংস্থাটি।