সাগরযাত্রার ব্যয় নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ী, জেলে

মাঝারি আকারের একটি ট্রলারে এখন শুধু ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৪০ হাজার ৮০০ টাকা।

সাগরে ইলিশ ধরার ভরা মৌসুম শুরু হয়েছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বরিশালসহ দক্ষিণের সমুদ্রগামী জেলে ও ট্রলারের মালিকেরা। লোকসানের আশঙ্কায় অনেক ট্রলার এখন সাগরে নেওয়া হচ্ছে না। আবার অনেক মালিক ট্রলার বিক্রি করে দেওয়ার কথাও ভাবছেন।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগে মোট ৩ লাখ ৬৫ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। গত বছর এই বিভাগে ইলিশ আহরণ করা হয় ৩ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর সারা দেশে সাড়ে ৫ লাখ টন ইলিশ আহরণ হয়েছিল। এ বছর দেশে ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ টন, যার মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ টন।

ট্রলারমালিক ও জেলেরা বলছেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে মাঝারি আকারের একটি ট্রলারে এখন শুধু ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৪০ হাজার ৮০০ টাকা। আর বড় ট্রলারে এই ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

পাথরঘাটা উপজেলার বাদুরতলা গ্রামের ট্রলারমালিক ইউনুস সরদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইলিশের ভরা মৌসুমে গত সপ্তাহে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বাজার করে সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করে ৪০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছি। এখন ডিজেলের মূল্য অনেক বেড়েছে। এই মূল্যে ডিজেলসহ বাজারসদাই করে মাছ ধরতে সাগরে ট্রলার পাঠানো অসম্ভব। তাই ট্রলার ঘাটে বেঁধে রেখে জেলেদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন যে অবস্থা, তাতে ট্রলার বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখি না।’

একই কথা বলেন পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের ট্রলারমালিক আবু বকর সিদ্দিক ও জাহাঙ্গীর খান। তাঁরা আরও বলেন, পাথরঘাটার অন্তত ৭০ ভাগ ট্রলারমালিক ও জেলেরা ডিজেল ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাছ শিকারের জন্য সাগরে ট্রলার পাঠাতে পারবেন না।

বাদুরতলার ট্রলারের মালিক হারুন হাওলাদার, পদ্মার সেলিম ঘরামী ও হাড়িটানার মুসা নাজির বলেন, ইলিশ মৌসুমভিত্তিক দাদন দিয়ে জেলেদের ট্রলারে নামানো হয়। কিন্তু বর্তমানে ডিজেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাগরে মাছ শিকার করতে না যেতে পারলে যেমন লোকসানে পড়তে হবে, তেমনি দাদনের টাকা গচ্চা যাবে। তাই এ ব্যবসা করা এখন কষ্টসাধ্য।

ট্রলারমালিকদের পাশাপাশি জেলেরাও তাঁদের পেশা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। পাথরঘাটার মঠেরখাল গ্রামের জেলে জাফর হালদার বলেন, ‘১৫ দিন আগে ১০ ব্যারেল (২০০০ লিটার) ডিজেল নিয়ে সাগরে মাছ শিকার করে তিন দিন আগে পাথরঘাটায় ফিরেছি। তাতেই ওই ২০০০ লিটার (তখন কেনা ছিল লিটারপ্রতি ৮০ টাকা) ডিজেলের দামে ওঠেনি। আর বর্তমানে তো ডিজেলের দাম বাড়তি। তাই এ পেশা না ছেড়ে এখন আর কোনো উপায় নেই।’

সাগর থেকে মাছ শিকার করে গত সোমবার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য বন্দরে ফিরে আসে এফবি এনি নামের একটি ট্রলার। ওই ট্রলারের মিস্ত্রি (ইঞ্জিনচালক) বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘এবার ৯ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছি। তবে আগের দুই ট্রিপে লোকসান হয়েছিল। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত লাভ হয়নি। ভেবেছিলাম এবার মাছ পেলে জেলেরা লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু ডিজেলে ব্যারেলপ্রতি ৬ হাজার ৮০০ টাকা দাম বাড়ায় সে আশার গুড়ে বালি। জেলেদের লোকসান গুনতে গুনতেই এবারের ইলিশ মৌসুম শেষ হবে।’

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাসুম আকন বলেন, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বেড়ে ১১৪ টাকা হয়েছে। মাঝারি আকারের একটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে জ্বালানি তেল, বরফসহ আনুষঙ্গিক খরচ পড়ছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। খরচ বাদে লাভ করা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই মাছ শিকারে অনেকেই সাগরমুখী হচ্ছেন না।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদার বলেন, এ বছর বরিশাল বিভাগে ইলিশ ধরার লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ টন। তবে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে এ সংকট কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত জেলেরা সমুদ্রগামী হবেন এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে তাঁরা আশা করছেন।