স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ৩ সংসদ সদস্য ধরাশায়ী

কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলা চারটি আসনে বিভক্ত। চারটি আসনে তিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীই স্বতন্ত্রদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। তাঁরা তিনজনই বর্তমান সংসদ সদস্য। এই তিন সংসদ সদস্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিলেন, এবার এর ধারেকাছেও নেই।

দলীয় কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঘাটতিতেই তাঁদের এমন ভরাডুবি হয়েছে।

কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু। তিনি তিনবারই জোটের শরিক হিসেবে দলীয় প্রতীক বাদ দিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। এবারও তা-ই করেছিলেন। টানা ১৫ বছর হাসানুল হক সংসদ সদস্য থাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদ নেতা-কর্মীদের বিরোধ দেখা দেয়। বিভিন্ন সময়ে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। তবে কয়েক মাস আগে ভেড়ামারাতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক হত্যার ঘটনায় বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এরপর দুই উপজেলার শীর্ষ নেতারা একজোট হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে মাঠে থাকার ঘোষণা দেন। তাঁরা স্থানীয় নেতা কামারুল আরেফিনকে সমর্থন দেন। কামারুল মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে তিনি প্রার্থী হন।

দলীয় নেতারা বলছেন, হাসানুল টানা ১৫ বছর ধরে সংসদ সদস্য থাকায় তাঁর দলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। দল কিংবা শরিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। এতে আওয়ামী লীগের নেতারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাসানুল নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন ট্রাক প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইনু পেয়েছিলেন ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩৬ ভোট।

জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগই কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীককে হারিয়েছে, এটা মানতে হবে। আওয়ামী লীগের কারণেই জোটের প্রার্থীর হার হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা হয়তো ভোটে কিছু কারচুপি করেছেন।’

আর মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আলীম বলেন, জাসদের নেতা-কর্মীরা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। কিন্তু শরিক দলের নেতা-কর্মী, এমনকি জনগণের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকেননি। এবার সেটার দাঁতভাঙা জবাব পেয়েছেন তাঁরা।

কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আ ক ম সরওয়ার জাহান। তিনি বর্তমান দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি এলাকায় তেমন থাকতেন না। সংসদ সদস্য হওয়ার পর এলাকামুখী হন। এলাকায় থাকলেও বেশির ভাগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল কম। তিনি এলাকায় নিজস্ব একটা বলয় তৈরি করেছিলেন। নানা কারণে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে যান। এবারের নির্বাচনে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন সরওয়ার।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭৫ ভোট পেলেও সরওয়ার এবার পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৯৬১ ভোট। দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল হক ট্রাক প্রতীকে ৮৯ হাজার ২৭৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের নাজমূল হক পান ৫৩ হাজার ১০৫ ভোট।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পান সেলিম আলতাফ জর্জ। সেলিম আলতাফ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। কুমারখালী ও খোকসায় সেলিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বড় বলয় তৈরি হয়। সেলিমের চাচা শামসুজ্জামান অরুণ কুমারখালী পৌরসভার মেয়র। কিন্তু গত পাঁচ বছরে নানা টানাপোড়েনে দলের কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। দুই উপজেলার প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায় সেলিমের। ভোটের কয়েক মাস আগে সেই বিরোধ কাদা-ছোড়াছুড়ি ও বিষোদ্গার পর্যায়ে পৌঁছায়। এতে অস্বস্তিতে পড়ে যান কর্মীরা। সেলিমের অপর পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দীন খান, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জাহিদ হোসেন ও কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান। তাঁরা এবারের নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই সেলিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। এতেই সেলিমকে পরাজিত হতে হয়।

এই আসনে ট্রাক প্রতীকে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফ ৯৮ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিম আলতাফ পেয়েছেন ৮০ হাজার ১১১ ভোট। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহিদ হোসেন বলেন, জর্জের মধ্যে রাজনৈতিক আচরণ অনুপস্থিত ছিল। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সম্মান দেননি। এ জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছেন। এ ছাড়া তাঁর চাচা মেয়র সামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে কুমারখালীতে দুর্নাম রয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে জর্জের ওপর।