পাবনা থেকে গাজীপুরে এসে সংগ্রহ করেন ‘চাঁইলতা’, পরে বানান মাছ ধরার চাঁই

গহিন বনে খুঁজে খুঁজে উপযুক্ত লতা সংগ্রহ করেছেন দিদার। রোববার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিন্দুবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বিকেলে কাঁধে করে বিশেষ একধরনের লতা নিয়ে নির্জন বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন। মাথায় ছোট্ট একটি পোঁটলা। বনের পাশ দিয়ে যাওয়া সড়কে পোঁটলা রেখে লতাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। গতকাল রোববার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিন্দুবাড়ি গ্রামে শাল–গজারির বনের পাশে তাঁর সঙ্গে দেখা। তাঁর নাম দিদার হোসেন। জানালেন, তাঁর বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামে। বাবার নাম মোকাব্বর মিস্ত্রি।

আলাপচারিতায় দিদার হোসেন বললেন, তাঁর কাঁধে থাকা লতাগুলোর নাম ‘চাঁইলতা’। এসব লতা সংগ্রহের জন্য পাবনা থেকে গত শনিবার তিনি শ্রীপুরে এসেছেন। থাকবেন সপ্তাহখানেক। এরপর বাড়ি গিয়ে লতাগুলো দিয়ে মাছ ধরার চাঁই বানাবেন। ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহে তিনি প্রতি মাসেই শ্রীপুরে আসেন।

খুব শক্তপোক্ত পাতাবিহীন লতাগুলো গজারিগাছের ডালপালায় আগাছার মতো জড়ানো থাকে। একেকটি লতা চার থেকে সাত ফুট লম্বা। চাঁই বানাতে দরকার পড়ে তুলনামূলক দীর্ঘ লতার। তাই গহিন বনে খুঁজে খুঁজে উপযুক্ত লতা সংগ্রহ করেছেন দিদার।

১০ বছর ধরে মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের চাঁই তৈরি করেন দিদার হোসেন। তিনি জানান, বাঁশ কেটে চির তৈরি করার পর সেগুলো ‘চাঁইলতা’ দিয়ে বাঁধতে হয়। এসব লতা শাল–গজারির বন ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইলের মধুপুর, গাজীপুরের শ্রীপুর ও গাজীপুর সদর এলাকায় শাল–গজারির বনে লতাগুলো পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ‘চাঁইলতা’ মেলে শ্রীপুরের বিন্দুবাড়ি, হায়াতখারচালা, বাউনী, সাতখামাইর, তেলিহাটি ও বরমী এলাকার বেশ কয়টি বনে।

গহিন বন থেকে ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহ করে বের হয়েছেন দিদার হোসেন। রোববার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বিন্দুবাড়ি এলাকায়
ছবি: সাদিক মৃধা

লতা সংগ্রহের পর সেগুলো শুকিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করেন দিদার। ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহ শুরু করার আগে বাড়িতে বাঁশের চির তুলে রোদে শুকাতে দিয়ে আসেন। পরিমাণমতো ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহ করার পর বাড়ির দিকে পা বাড়ান। লতা ও বাঁশের চির দিয়ে মাছ ধরার চাঁই তৈরিতে তাঁকে সহযোগিতা করেন ছোট ভাই ও বাবা। প্রকারভেদে একেকটি চাঁই ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিটি চাঁই বিক্রিতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ হয়।

পাবনার চাটমোহর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি উপজেলার গ্রামের বাজারে এসব চাঁই বিক্রি হয়। এগুলো বিক্রি করে স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ চালান দিদার। তাঁর ভাষ্য, শুধু ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহ করে সেগুলো চাঁইয়ের কারিগরের কাছে বিক্রি করার জন্য বেশ কয়েকজন লোক কাজ করেন। তাঁদের কাছ থেকে ‘চাঁইলতা’ কিনে খুব ভালো লাভ করা যায় না। তাই কষ্ট হলেও নিজেই লতা সংগ্রহ করেন।

দিদারের গ্রামে চাঁই তৈরির ১০ থেকে ১২ জন কারিগর আছেন। ‘চাঁইলতা’ সংগ্রহে তাঁর সঙ্গে একই গ্রামের আরও দুজন এসেছেন। তাঁরা শ্রীপুরের অন্যান্য বনে লতা সংগ্রহ করছেন। দিদার বলেন, সারা দিন বনের ভেতরে লতা সংগ্রহ করতে করতে সন্ধ্যা হলে বন থেকে বেরিয়ে আশপাশের কোনো লোকালয়ে চলে আসেন। সেখানে কোনো মসজিদের বারান্দা কিংবা দোকানপাটের বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটান। তাঁর সঙ্গে থাকা পোঁটলার ভেতর থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শুকনা খাবার ও টাকাপয়সা। আগে বনগুলোয় প্রচুর ‘চাঁইলতা’ পাওয়া যেত। বর্তমানে লতার পরিমাণ কমে গেছে।