দারিদ্র্যের শিকল ছিঁড়ে নতুন শুরু

বাবাকে হারানোর পর মায়ের ত্যাগ আর লড়াইয়ে জীবনের সংগ্রামে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে আনিকা। অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে সংবাদপত্রের হকারের কাজে সঙ্গী হয়েছে দিলীপ। লামিয়ার লড়াইটাও সমাজের অন্য কিশোরীদের মতো নয়। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর নিজের পড়ালেখার হাল ধরতে মায়ের সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করে সে। আর দিনমজুর দম্পতির সন্তান প্রহ্লাদ দারিদ্র্য জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার শক্তিতে।

এই অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা এবার দেশের চারটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের সবার রয়েছে স্বপ্ন। দারিদ্র্যের শিকল ছিঁড়ে জীবনকে নতুন আঙ্গিকে দেখতে তাঁরা পড়ালেখাকে সবচেয়ে বড় অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে।

মায়ের লড়াইয়ে জয়ী আনিকা

আনিকা আক্তার যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত তখন না ফেরার দেশে চলে যান তার বাবা মো. ফারুকুল ইসলাম। এরপর দারিদ্র্যের সংসারে আনিকাকে নিয়ে একাই পাঁচটি বছর পাড়ি দেন মা আয়েশা খাতুন। বই কেনা, পরীক্ষার ফি দেওয়ার মতো টাকা ছিল না। তবে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সংগ্রামী আনিকার অদম্য লড়াইয়ের সামনে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ভোলাচং উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে আনিকা।

আনিকা আক্তার প্রথম আলোকে বলে, ‘বাবার আদর–স্নেহ পেলেও সে কথা মনে নেই। মা আমার সব। এক চাচি পরীক্ষার ফি জোগাড় করে দিতেন। বই কেনাসহ অন্যান্য টাকা মামা দিতেন। অসংখ্য দিন না খেয়ে কাটিয়েছি। পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।’

আনিকাদের বাড়ি নবীনগর উপজেলার ভোলাচংয়ের কাজীমাবাদ শালকান্দি গ্রামে। তার মা আয়েশা খাতুন বলেন, ‘ওর পড়াশোনা নিয়ে চিন্তায় আছি। আমি চাই মেয়েটা পড়াশোনা চালিয়ে যাক। কিন্তু কলেজে ভর্তি, বই–খাতা–কলম, কলেজের বেতন, পোশাক এসব নিয়ে কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।’

পত্রিকাও বিক্রি করেছে অপু

৩৫ বছর ধরে রোজ সকালে অফিসে, দোকানে কিংবা মানুষের বাড়িতে সংবাদপত্র পৌঁছে দেন দিলীপ কুমার। শরীরে এখন আর আগের মতো কুলায় না। তাই এ কাজে দিলীপকে সহায়তা করে তাঁর সন্তান অপু কুমার। বাবার কাজটি করে দেওয়ার পর বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখাও ঠিকঠাক করেছে সে। এবার এসএসসি পরীক্ষায় নাটোর শহরের গ্রিন একাডেমি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে অপু।

অপুদের বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার মল্লিকহাটি মহল্লায়। তার বাবা দিলীপ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের সন্তানের সাফল্যের খবর পত্রিকায় ছাপা হলে আমি দিনের শুরুতে সেই সন্তানের বাবার হাতে পত্রিকা তুলে দিয়ে আসি। মনে মনে ভাবি, আমার সন্তানেরা কি পত্রিকায় ছাপার মতো ভালো ফল করবে না। সেই পত্রিকা হাতে নিয়ে আমার ছেলে কি আমার সামনে দাঁড়াবে না। ভরসার প্রতিদান সে দিয়েছে।’

রাজমিস্ত্রির জোগালি ছিল লামিয়া

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম রাজমিস্ত্রি বাবা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। পাঁচ সদস্যের সংসার চলে দিনমজুর মা আর ভ্যানচালক ভাইয়ের রোজগারে। সব প্রতিকূলতা পাশ কাটিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দরগাহপুর গ্রামের লামিয়া খাতুন প্রমাণ করেছে, সংকল্প আর দৃঢ়তাই মুখ্য। এ বছর শ্যামনগরের ভুরুলিয়া নাগবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে।

লামিয়া জানায়, বাবার অসুস্থতার পর পড়ার খরচ জোগাতে মায়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজে নেমে পড়ে সে। পাশাপাশি অসুস্থ বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালন করত। সামনের কঠিন পথ চলার ক্ষেত্রে একটু সহায়তা পেলে লামিয়া প্রকৌশলী বা চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চায়।

চিকিৎসক হতে চায় প্রহ্লাদ

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ভাদুয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ চন্দ্র রায় আর গোলাপি রানী রায়ের সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। ভূমিহীন পরিবারের এই দম্পতি দিনমজুরের কাজ করে সংসারের দারিদ্র্য সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের ঘরে আলো হয়ে এসেছে সন্তান প্রহ্লাদ চন্দ্র রায়। সে এবার ভাদুয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতে সংসারের অভাবে যখন বইপত্র কেনা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল, তখন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো শুরু করে প্রহ্লাদ। সেই টাকায় নিজের ও বোনের জন্য খাতা-কলম কিনত। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে এক আত্মীয় তাকে অনেকবার সহায়তা করে। শিক্ষকেরাও অদম্য মেধাবী প্রহ্লাদকে প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা নিতেন না। পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে প্রহ্লাদ।

ভাদুয়া উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফারুক হাসান বলেন, ‘দারিদ্র্যের বাধা ছেলেটাকে আটকে রাখতে পারেনি। তার বাবা আমাদের স্কুলের কয়েক শতক জমি বর্গা চাষ করে সংসার চালান।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন শাহাদৎ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; মুক্তার হোসেন, নাটোর; কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা ও কাজী নুরুল ইসলাম, পীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও]