আশ্রয়কেন্দ্রে আনন্দময় সময় কাটছে শিশুদের

শিশুদের পাঠদান করছেন হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাস। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

হাকালুকি হাওর এখন বর্ষার পানিতে থই থই করছে। পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে আছে হাওরপারের পথঘাট, হাটবাজার, ঘরবাড়ি। অনেকের বাড়িতেই হাঁটুপানি, কোমরপানি। বন্যাকবলিত অনেক বাড়ির মানুষ ঘর ছেড়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন কাছাকাছি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয় এ রকমই একটি আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে আশ্রয় নিয়েছে ৩২টি পরিবার। এসব পরিবারের শিশুদের ‘আশ্রয়কাল’কে আনন্দময় করে তুলতে ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাস। তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিচ্ছেন, সচেতন করছেন নানা বিষয়ে।

হাকালুকি হাওরপারের প্রত্যন্ত এলাকা মুর্শিবাদকুরা, বড়ময়দান ও পূর্ব গগড়া গ্রামে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘরবাড়ি তলিয়ে গেলে লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে শুরু করে। এর অধিকাংশই মৎস্যজীবী পরিবার।

২০২২ সালেও এলাকায় এ রকম বন্যা হয়েছিল। সেবারের অভিজ্ঞতা খুব সুখবর ছিল না হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাসের। গত রোববার (৭ জুলাই) তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সারা স্কুল ক্যাম্পাস ময়লা, নোংরা-আবর্জনায় ভরে গিয়েছিল। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ যাওয়ার পর তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে অনেক সময় লেগেছে। এবার আশ্রয়কেন্দ্রে লোক ওঠার পরই সিদ্ধান্ত নিলেন, সকাল-সন্ধ্যা স্কুলে থাকবেন। যেখানে-সেখানে যাতে কেউ মলমূত্র, আবর্জনা না ফেলে, সে জন্য শিশুদের সচেতন করবেন। তাদের পড়াবেন।

সে অনুযায়ী ২০ জুন থেকে বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধান শিক্ষক ও দপ্তরি সকাল ১০টার মধ্যেই স্কুলে চলে আসেন। এরপর আশ্রয় নেওয়া মানুষের সুবিধা-অসুবিধা তদারক করেন। বেলা তিনটায় শুরু করেন পাঠদান। আশ্রয় নেওয়া দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণির ২৫ শিক্ষার্থীকে তিনি বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বই পড়ান। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এই শিক্ষার্থীদের আনন্দ বাড়িয়ে তুলতে হালকা নাশতারও ব্যবস্থা করেন প্রধান শিক্ষক।

মুর্শিবাদকুরা গ্রামের ব্র্যাক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জামিলা বেগম বলে, ‘ইশকুলে আওয়ার পরে হেড স্যার (প্রধান শিক্ষক) আমরারে পড়াইরা। আমরারে নাশতা, খাতা-কলম দিছইন (দিয়েছেন)। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কীভাবে থাকতাম, শিখাইরা (শিখাচ্ছেন)।’ একই গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির রাজু আহমদ বলে, ‘বন্যায় ঘুরদুয়ার ভাঙিলিছে (ভেঙে ফেলছে)। ইকানো আইয়া (এখানে এসে) আমরা বন্দী। মাঠে পানি। পড়ালেখা বন্ধ। কিন্তু ইশকুলের হেড স্যারে আমরারে অনেক মায়া কররা (করছেন)। তাইন (তিনি) আমরা সবে কিলা-রইয়ার (কেমনে থাকছি), সব খোঁজ নিরা (নিচ্ছেন)। আমরারে পড়াইরা। নাশতা দিরা (দিচ্ছেন)।’

আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবার নিয়ে উঠেছেন বড়ময়দান গ্রামের ফখর উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘হেড স্যারে আমার হুরুতারে (বাচ্চাদের) লেখাপড়া করাইরা (করাচ্ছেন)। খাতা-কলম, নাশতা দিরা (দিচ্ছেন)। প্রতিদিন বিকাল টাইমে এক ঘণ্টা–দেড় ঘণ্টা পড়াইরা। লেখাপড়াত থাকায় হুরুতা আনন্দে আছে। ফুর্তিত আছে। হুরুতারে নিয়া আর টেনশন নাই। দিনে স্কুল করিয়া রাইত তারা পড়া লইয়া ব্যস্ত থাকে।’

প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাসের বাড়ি প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামে। রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় নৌকা দিয়ে আসা-যাওয়া করেন। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত স্কুলে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিকেলে ক্লাসের সময় হলে তিনি ঘণ্টা বাজান। তখন শিক্ষার্থীরা ক্লাসে চলে আসে। তাদের পাঠ্যসূচির বইয়ের পাশাপাশি খোলা জায়গায় পায়খানা না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়েও সচেতন করার চেষ্টা করেন। এর সুফলও পাচ্ছেন। ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে নিজেরও ভালো লাগে।

দুই সপ্তাহের ওপরে স্কুলে আছে সবাই। তবে দুই সপ্তাহ ধরে ক্লাস চলছে। পানি কিছুটা কমে স্কুলের মাঠ শুকিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি হওয়ায় আবার আগের জায়গায় পানি ফিরে এসেছে। ফলে বানভাসি লোকজনকে বেশ কিছুদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হবে।

প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘গতবার (২০২২) যে রকম অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল, এবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্কুল দেখলে তা কেউ অনুমান করতে পারবে না। আমি নলকূপ থেকে পানি তুলে দিই। সবাই খুব সুশৃঙ্খলভাবে বসবাস করছে।’

আশ্রয়কেন্দ্রের অভিভাবক খালেদা বেগম বলেন, ‘আমরা তো মনে করছিলাম, বন্যার কারণে বাচ্চাইনতরে পড়াইতাম পারতাম নায়। কিন্তু ইশকুলে আইয়া একটু সুবিধা অইছে (হয়েছে), বাচ্চাইনতরে লেখাপড়া শিখাইতাম পাররাম (পারতেছি)। স্যারে সব সময় খোঁজখবর কররা (করছেন), সহযোগিতা কররা।’

সম্প্রতি আশ্রয়কেন্দ্রটি ঘুরে দেখেছেন বড়লেখার সাংস্কৃতিক সংগঠক তপন কুমার দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরো ক্যাম্পাস জলমগ্ন। শিশুদের খেলাধুলা দূরের কথা, ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই। এর মধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছায় পাঠদানের উদ্যোগ নিয়েছেন। দিনে শিশুরা ক্লাস করছে, রাতে পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। শিশুরা অনেক আনন্দে থাকছে।