মুকুলের বদলে লিচুগাছে নতুন পাতা বেশি এসেছে। গত রোববার দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ছেতরা বাজার থেকে কাশিডাঙ্গা বাজার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তার উভয় পাড়ে যতদূর চোখ যায় লিচুর বাগান। ভালো ফলনের আশায় গাছের গোড়াসহ পুরো জমির আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। কেউ সেচ দিয়েছেন, কেউবা সেচ দেওয়ার অপেক্ষা করছেন। সবুজ ও তামাটে পাতার ফাঁকে উঁকি দিতে শুরু করেছে লিচুর মুকুল। 

সাধারণত মাঘের শেষ সপ্তাহ থেকে ফাল্গুনের মাঝামাঝি লিচু গাছে মুকুল আসে। তবে এবার মুকুলের বদলে অধিকাংশ গাছে নতুন পাতা বের হয়েছে। চাষিরা বলছেন, নতুন পাতা বের হওয়া গাছে মুকুল আসার সম্ভাবনা কম। ফলে গতবারের তুলনায় লিচুর ফলন কম হবে এমনটাই আশঙ্কা করছেন দিনাজপুরের লিচুচাষিরা।

বিভিন্ন এলাকায় এবার লিচুগাছে মুকুল কম ধরেছে। অধিকাংশ গাছে নতুন পাতা বেশি বের হয়েছে। এ কারণে লিচুর ফলন কমার আশঙ্কা রয়েছে।

লিচুর রাজ্য বলে খ্যাতি আছে দিনাজপুরের। জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে লিচুকে দিয়ে। এখানে চাষ হয় চায়না থ্রি, বেদানা, বোম্বাই, মাদ্রাজি, কাঁঠালি, বেদানা জাতের লিচু। জেলার প্রায় সব জায়গাতে কম বেশি লিচুর চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সদর উপজেলার মাসিমপুর, ঘুঘুডাঙ্গা, বিরলের মাধববাটি, করলা, রবিপুর, রাজারামপুর, মহেশপুর, বটহাট এবং চিরিরবন্দর-খানসামা উপজেলায়। লিচু চাষের জন্য উপযোগী বেলে-দোআঁশ মাটি হওয়ায় এ অঞ্চলে লিচু চাষে কৃষকের আগ্রহও বাড়ছে দিন দিন। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় ৫ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান আছে ৫ হাজার ৪১৮টি। এর মধ্যে বোম্বাই লিচু ৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে, মাদ্রাজি ১ হাজার ১৬৬ হেক্টর, চায়না থ্রি ৮০২ হেক্টর, বেদানা ২৯৫ দশমিক ৫ হেক্টর, কাঁঠালি ৫৬ হেক্টর এবং মোজাফফরপুরী লিচু ১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। আর বসতবাড়ির উঠানসহ বাগানগুলোতে লিচুগাছ রয়েছে প্রায় সাত লাখ। এবার লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩১ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন। 

গত দুই দিন দিনাজপুর সদর ও বিরল উপজেলার কয়েকটি লিচুবাগান ঘুরে দেখা যায়, গাছে গাছে তামাটে রঙের নতুন পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে নাকফুলের মতো মুকুল। মুকুলের হাটে মৌমাছির গান মিলিয়ে যাচ্ছে ফাল্গুনের বাতাসে। গাছের গোড়াকে আগাছামুক্ত করেছেন কৃষক। প্রথম পর্বের পরিচর্যাসহ একবার কীটনাশক ছিটানো (স্প্রে) হয়েছে।

বিরলের রাজারামপুর এলাকায় ১১ একর জমিতে ৭০০ গাছ নিয়ে ফেরদৌস আলমের লিচু বাগান। তিনি জানান, বোম্বাই ও মাদ্রাজিতে এবার মুকুল কম এসেছে। দুই বছর থেকে ফলন কম হচ্ছে বাগানে। এবার নিড়ানি দেওয়া হয়েছে। মুকুল থেকে গুটি বের হলেই সেচ দেওয়া শুরু করবেন। তিনি বলেন, ‘শীত কম হওয়ায় মুকুল ঠিকমতো আসেনি। মুকুল আসার আগেই গাছের পাতা ছেড়ে দিয়েছে। তা ছাড়া একবার ফলন ভালো হলে পরেরবার ফলন একটু কমে যায়।’

বিরলের রবিপুর গ্রামের লিচুচাষি শিশির শাহ বলেন, ‘৩০ একর জমিতে লিচুবাগান আমাদের। গত বছর প্রায় সব গাছে মুকুল এসেছিল। ফলনও ভালো ছিল। এবার তাড়াতাড়ি সবুজ ও তামাটে পাতা ছেড়ে দিয়েছে গাছগুলো। কিছু ডালে মুকুল আছে, তবে পাতার আধিক্যই বেশি। যদিও মুকুল আসার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। ফাল্গুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুকুল আসার সময়। জানালেন, আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এবার কমপক্ষে ৪০ শতাংশ লিচুর ফলন কম হবে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন, যাঁরা আগাম বাগান লিজ নিয়েছেন। গত মৌসুমে প্রায় ৩০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছি।’

সদর উপজেলার রানীগঞ্জ এলাকার লিচুচাষি মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবার ১০ থেকে ১২টি বাগান লিজ নিই। এবার ৪টি বাগান লিজ নিয়েছি। প্রায় ৩০০ গাছ আছে।’ তিনি বলেন, সব এলাকায় পাতা–মুকুল বের হয়েছে এমনটা নয়। জানালেন, এবার খানসামা-চিরিরবন্দর এলাকায় লিচুতে ভালো মুকুল আসছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে ফলনও ভালো হবে।

মুকুলের বদলে সবুজ পাতার আধিক্যের বিষয়ে দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, লিচুর মুকুলের জন্য পানি-শীত ও সার ব্যবস্থাপনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুকুল আসার সময় টানা ২ সপ্তাহ ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা দরকার। এবার শীত কম ছিল। অন্যদিকে মুকুলের গুটি শক্ত হওয়ারে আগে সেচ দেওয়া হলে ফ্লাওয়ারিং হরমোন কম হবে, বৃদ্ধিজনিত হরমোন বেশি হবে। মূলত হরমোনের অসামঞ্জস্যতার কারণে গাছে মুকুলের বদলে সবুজ কচি পাতা দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া গত দুই বছর ফলন ভালো হয়েছে। এখানে মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগেরও কিছু বিষয় থাকে।’

এ বিষয়ে দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. খালেদুর রহমান বলেন, দিনাজপুর জেলা লিচু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। মুকুল ছাড়ার আগে গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়া কিংবা বিষ প্রয়োগ করলে গাছ কচিপাতা ছাড়ে। এবার শীত কিছুটা কম হওয়ায় ফলনের তারতম্য হতে পারে। তবে এখন মুকুল আসার সময় আছে। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগ না করা, মুকুল ধরে রাখা, হপার পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সেচসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে । তিনি আরও বলেন, এবার হেক্টরপ্রতি ৫ দশমিক ৭৯ মেট্রিক টন লিচুর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর দিনাজপুরে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন লিচুর ফলন হয়েছে, যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।