সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেকে

  • শের–ই–বাংলা হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে শয্যা রয়েছে ১১২টি।

  • ২০২৩ সালে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ১৬ হাজার ২০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। 

পদ্মা সেতু নির্মাণের পর বরিশালসহ দক্ষিণের সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন হয়েছে। বেড়েছে সড়কে মানুষের চলাচল। যাত্রী পরিবহনের জন্য বেড়েছে পাল্লা দিয়ে যানবাহনের সংখ্যা। ফলে গত দুই বছরে বরিশালসহ আশপাশের এলাকা দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে।

চিকিৎসা–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরিশালসহ আশপাশের এলাকার রোগীদের একমাত্র ভরসা শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে যাঁরা পঙ্গুত্ব নিয়ে বা হাত-পা ভাঙা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁরা বেশির ভাগই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। আর শিশুদের একটা বড় অংশ ছাদ বা গাছ কিংবা উঁচু জায়গা থেকে পড়ে আঘাত পাচ্ছে। বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়ও। এমন পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পঙ্গু দিবস’।

যাঁরা হাত-পা ভাঙা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁরা বেশির ভাগই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। 

শের-ই-বাংলা হাসপাতালের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ১৬ হাজার ২০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪৪ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। এ সংখ্যা অন্য বছরের তুলনায় শতকরা ২০ ভাগ বেশি। এ বছর রোগী আরও বেশি হতে পারে। 

তিন চাকার অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাতেন ঝালকাঠির নেছারাবাদ এলাকার ১৬ বছরের কিশোর মাসুদ মিয়া। কিন্তু ৯ মার্চ অটোরিকশা রাস্তার পাশের গর্তে পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে গেছে তার। সেদিনই ভর্তি হয় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে। সেখানে তার পায়ের ওপরের অংশে ইস্পাতের সরু পাইপ ও নিচে ইট বেডের সঙ্গে ঝুলিয়ে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। গত বুধবার দুপুরে হাসপাতালে কথা হয় মাসুদের বাবা সোহেল মিয়ার সঙ্গে। ছেলের মাথার কাছে বসেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, অস্ত্রোপচার লাগবে কি না, প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে বিষয়ে জানা যাবে। সোহেল বলেন, ‘চিকিৎসা এহনো শুরুই অয় নায়। অ্যারপর যে কত টাহা লাগবে, কইতে পারি না। এতো টাহা পামু কই। আর এতো টাহা খরচের পরেও যে পোলা ভালো হইবে এমন কথাও নাই।’ 

সোহেল মিয়া এ আশঙ্কা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে করছেন। কারণ, বছর চারেক আগে তিনিও অটোরিকশা চালাতেন। গাছ বহনকারী একটি টমটমের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তাঁর গাড়ি উল্টে পড়ে। এতে বাম পা ভেঙে এখন প্রায় অচল তিনি। তিন লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। এরপরও পা সোজা করতে পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়ে কিশোর ছেলে মাসুদের হাতে তিন চাকার যানটির ভার ছেড়ে দেন বাবা সোহেল মিয়া। এরপর মাসুদের আয়েই সংসার চলত। কিন্তু এখন মাসুদেরও তাঁর মতো অবস্থা। 

সোহেল মিয়া বলেন, স্যানিটারি দোকানে কাজ করে সামান্য কিছু আয় হয়। কিন্তু তাতে সংসার চলে না। এখন মাসুদের এই অবস্থা। এ অবস্থায় কীভাবে চিকিৎসার টাকা জোটাবেন, আর কীভাবে সংসার চলবে, সেই চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছেন। 

বরিশাল শের-ই-বাংলা হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পুরুষ ও নারী ওয়ার্ড মিলে শয্যা রয়েছে ১১২টি। এর মধ্যে পুরুষ ওয়ার্ডে ৪৮টি সাধারণ ও ১০টি পেয়িং বেড। পেয়িং বেডের জন্য দৈনিক ৩৫০ টাকা করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এ ছাড়া নারী ওয়ার্ডে সাধারণ শয্যাসংখ্যা ৪৬টি এবং শিশুদের জন্য আছে ৮টি।

হাসপাতালের দায়িত্বরত জ্যেষ্ঠ এক সেবিকা জানান, বুধবার তাঁদের রেজিস্ট্রার খাতা অনুযায়ী পুরুষ ওয়ার্ডে ৭৮ রোগী ভর্তি রোগী ছিল। এ ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হচ্ছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার রোগী বেশি। এ ছাড়া রয়েছে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, বিভিন্ন কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া ইত্যাদি। মহিলা ওয়ার্ডের অবস্থাও প্রায় কাছাকাছি। সেখানের ৫৪টি শয্যার মধ্যে ৫২টিই পূর্ণ। এখান থেকে গড়ে রোজ চার থেকে পাঁচজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) পাঠানো হয়। 

চিকিৎসকেরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই পঙ্গুত্ব বরণ করেন। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও তাঁরা ভারী কাজ করতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জরুরি, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এখন দুই-তিন চাকার যানের দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আহত হচ্ছেন। তবে সেসব গণমাধ্যমে আসছে না। 

গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয় ৯৯২ জন। অন্যদিকে দেশে সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮২টি। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৯৮ জন, আর আহত হয়েছেন ৮৮৫ জন। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, এখানে মাত্র ছয়জন সহকারী অধ্যাপকসহ ৮-৯ জন চিকিৎসক আছেন। আছে আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব। আর বর্তমানে পরিবহন, ওষুধ ও চিকিৎসার অন্যান্য সরঞ্জামসহ সবকিছুর দাম বেশি। ফলে চিকিৎসার ব্যয়ও আগের চেয়ে অন্তত ২০ ভাগ বেড়েছে। তবে তাঁরা সাদ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।