ঘুম কেড়ে নিয়েছে মশা, চিকুনগুনিয়ার আতঙ্ক

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের মশাছবি : রয়টার্স

চট্টগ্রাম নগরে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েছে মশার উৎপাতও। কখন ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন হামজারবাগের বাসিন্দা তন্বী পাল। এই গৃহিণীর বেশি চিন্তা দেড় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে। কয়েল জ্বালিয়ে, মশারি টানিয়ে মশার কামড় থেকে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।

তবে সব চেষ্টা করেও রক্ষা হয়নি নগরের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষিকা ইশরাত জাহানের। মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি ও তাঁর স্বামী। তীব্র ব্যথার যন্ত্রণা নিয়ে দিন পার করতে হয়েছে দুজনকে। স্বামী সেরে উঠলেও পুরোপুরি সুস্থ হননি ইশরাত জাহান। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হচ্ছে তাঁকে।

অনেক ওয়ার্ডে মশকনিধনের কার্যক্রম এখন অনেকটাই কমে গেছে। আগ্রাবাদে গিয়ে দেখলাম, যতক্ষণ আমি ছিলাম ততক্ষণ স্প্রে করা হয়েছে, পরে কাজ বন্ধ।
শাহাদাত হোসেন, মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

ইশরাত জাহান ও তন্বী পালের বাসা চট্টগ্রাম নগরের দুই প্রান্তে। দূরত্বের হিসেবে প্রায় ১৪ কিলোমিটার। দুই প্রান্তে থাকলেও তাঁদের একপ্রকার ‘ঘুম’ কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট প্রাণী মশা। এই দুর্ভোগের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও গাফিলতিকে দায়ী করছেন দুই বাসিন্দা। তাঁদের মতে, সিটি করপোরেশনের অন্যতম কাজই হচ্ছে মশা মারা। এই কাজে করপোরেশনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছেন না তাঁরা। সিটি করপোরেশন যদি ঠিকভাবে মশা মারার কাজ করত, তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না।

তাঁদের মতো নগরবাসীর দুশ্চিন্তা কমাতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ ও মশকনিধনে গত ২৮ জুন ১০০ দিনের ক্র্যাশ কর্মসূচি শুরু করে সিটি করপোরেশন। যে কর্মসূচি এখনো চলমান। এই কার্যক্রমের ফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। কেননা, এই কর্মসূচি চলার মধ্যেই বেড়ে চলছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন নিজেই মশকনিধন কর্মসূচির গাফিলতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গত ৬ আগস্ট সিটি করপোরেশনের এক সভায় মেয়র বলেন, ‘অনেক ওয়ার্ডে মশকনিধনের কার্যক্রম এখন অনেকটাই কমে গেছে। আগ্রাবাদে গিয়ে দেখলাম, যতক্ষণ আমি ছিলাম ততক্ষণ স্প্রে করা হয়েছে, পরে কাজ বন্ধ।’

গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪০০ জন। দুই মাসে মৃত্যু হয়েছিল দুজনের। এবার এই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৩৫ জন। আগের বছরগুলোতে চিকুনগুনিয়ার হিসাব রাখা হতো না। এবার তালিকা করা হচ্ছে। চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২২১ জন।

অবশ্য বরাবরের মতো নিজেদের গাফিলতি অস্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তারা। করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়ম করে এলাকা ভাগ করে রুটিন অনুযায়ী ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। হটস্পটগুলোতে বিশেষ দল কাজ করছে। তারপরও কয়েকটি সংকটের কারণে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

তিন সংকটে চসিক, বাড়ছে রোগী

জুলাইয়ের পর থেকে চট্টগ্রাম নগরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৯০৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথম ছয় মাসে যেখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪৪৫ জন, সেখানে ১ জুলাই থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৫৯। মারা যাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনই মারা গেছেন এই সময়ে।

গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৪০০ জন। দুই মাসে মৃত্যু হয়েছিল দুজনের। এবার এই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৩৫ জন। আগের বছরগুলোতে চিকুনগুনিয়ার হিসাব রাখা হতো না। এবার তালিকা করা হচ্ছে। চলতি বছরে গতকাল পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২২১ জন।

সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের এক কর্মকর্তা এমন পরিস্থিতির জন্য তিন সংকটকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নিবিড়ভাবে মশা মারার ওষুধ ছিটানোর জন্য অন্তত সাড়ে চার শ কর্মী দরকার। কিন্তু আছে আছে ২৭০ জন। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন আবার বিশেষ দলের সদস্য। বাকি ২০০ সদস্য ওয়ার্ড পর্যায়ে কাজ করেন। নগরের ওয়ার্ডগুলোর আয়তনের তুলনায় এই জনবল কম। আর দুটি সংকট হচ্ছে বাজেট স্বল্পতা এবং পর্যাপ্ত ওষুধের অভাব। মশকনিধন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতি অর্থবছরে বাজেটে ৮-৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে বরাদ্দ পাওয়া যায় তিন ভাগের এক ভাগ। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ কেনা যায় না। ওই কর্মকর্তার মতে, নগরের সব কটি ওয়ার্ডে ছিটানোর জন্য বছরে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইডের (পূর্ণবয়স্ক মশা মারার ওষুধ) প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশন কিনে ২৫ থেকে ৩০ হাজার লিটার। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় অর্ধেক। ফলে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম চলে টেনেটুনে।

সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়। কারণ, এই সময়ে বর্ষাকাল শুরু। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই এই সময়টাকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেওয়া হয়। তবে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বরের পরেও ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে।

২০২১ সালে মশা নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য সিটি করপোরেশন গঠিত গবেষক দলের সদস্যসচিব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এবার ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ খুবই বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার বিষয়ে চার বছর আগে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিলেন। বিশেষ করে গণসচেতনতা, মশকনিধনে প্রযুক্তির ব্যবহার। কিন্তু এগুলোর কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। আগের মতোই চলছে মশকনিধন কার্যক্রম। ফলে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না।