ফুটবলার থেকে চরমপন্থী নেতা, মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচলেও প্রাণ হারালেন গুলিতে
ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল হানেফ আলীর। অল্প বয়সে ভালো ফুটবলার হয়ে ওঠায় নিজ এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের মাঠেও তাঁর ডাক পড়ত। ফুটবলার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক নানা কাজে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। নানা অন্যায়েরও প্রতিবাদ করতেন। গ্রামের মানুষও তাঁকে মান্য করতে শুরু করেন।
হানেফ আলীর (৫৬) বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামে। স্বজন ও গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, ১৯৯০ সালের দিকে তিনি নজরে পড়েন তৎকালীন দুই চরমপন্থী নেতার। তাঁদের চাপ আর হুমকিতে যোগ দেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিতে। একের পর এক ১৪টি হত্যা মামলায় তাঁর নাম আসে। যার একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলেও ১৫ বছর কারাভোগের পর কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় ‘স্বাভাবিক জীবনে’ ফেরেন। সেই জীবন থেমে গেল দুর্বৃত্তদের গুলিতে।
২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় হানেফ আলীসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের সবাইকে মাথায় ও বুকে গুলি করা হয়েছিল। নিহত অন্য দুজন হলেন হানেফ আলীর শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন হোসেন (৩৫) ও কুষ্টিয়া সদরের পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলাম (২৫)। আরেক চরমপন্থী দল জাসদ গণবাহিনী বার্তা পাঠিয়ে এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ‘কালু জাসদ গণবাহিনীর’ নামে বার্তা নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছয় ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন হানেফ আলী। রাহাজ উদ্দিন কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি হানেফ। ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে নেমে পড়েন। গ্রামের বাসিন্দা ও হানেফ আলীর চাচাতো ভাই আবদুল গনি বলেন, ‘হানেফ ছোট থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। কিন্তু এভাবে যে তাদের (চরমপন্থী) সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে, কেউ ভাবতে পারিনি। তবে পরবর্তী সময়ে সে ভালো হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে বর্তমানে কৃষিকাজ ও মাছ চাষ করে সংসার চালাত।’
সম্পর্কে বড় ভাবি হলেও সুজাত আরা বেগম ছিলেন হানেফ আলীর সমবয়সী। গ্রামে একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন দুজন। দেবরের সম্পর্কে সুজাত আরা বলেন, হানেফ তো এমন ছিলেন না। ছোট থেকে গ্রামে ভালো ফুটবলার হিসেবে নাম ছিল। আশপাশের গ্রামে খেলা হলে ডাক আসত। একপর্যায়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পার্শ্ববর্তী গ্রামের টিপু ও মোয়াজ্জেমের নজরে পড়ে যান হানেফ। প্রথমে টিপু তাঁদের বাড়িতে এসে হানেফকে বোঝাতে থাকেন। এরপর মোয়াজ্জেম আসতেন। হানেফ রাজি না হলে এক দিন তাঁরা বাড়ির বাইরে এক স্থানে কাফনের টুকরা কাপড় ও সাবান রেখে যান। সঙ্গে একটি চিঠিও দেন। যাতে লেখা হয়, হানেফের সময় শেষ, যা ইচ্ছা তা সেরে নেওয়ার।
সুজাত আরা বেগম বলেন, চিঠি পেয়ে হানেফ বুঝে নেন, চরমপন্থী নেতারা তাঁর পিছু নিয়েছেন, কোনোভাবেই তাঁরা ছাড়বেন না। তখন একদিন খবর দিয়ে বাড়িতে হাজির করেন তৎকালীন নেতা টিপু ও মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তাঁদের নিয়ে বাড়িতে খেজুরের গুড় ও মুড়ি খাওয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে হানেফ আলীকে শপথ করানো হয়। এই শপথের পর হানেফ তাঁদের দলে যুক্ত হয়ে যান। তিনি আরও বলেন, যারা হানেফকে দলে নিয়েছেন, তাঁরা দুজনই মারা গেছেন। তাঁদের কারণে আজ হানেফ আলীকেও মরতে হলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আহাদনগর গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, হানেফ আলী নব্বই দশকে চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। জনযুদ্ধের আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, কুষ্টিয়ার কিছু অংশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলাচল করতেন। তাঁর চলার পথে কোনো বাধা রাখতেন না তিনি। একে একে ১৪টি হত্যা মামলায় আসামি হয়ে যান। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বোমা হামলার মামলা হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে হানেফ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর কারাভোগের পর ২০১৬ সালের দিকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালে হানেফ আলী ছাড়া পাওয়ার পরের বছর ২০১৭ সালে নারানকান্দি বাঁওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। পরবর্তী সময়ে এই বাঁওড়ের কর্তৃত্ব নেন হানেফ আলী। শুরু করেন মাছের চাষ, নাম লেখান প্রকাশ্য রাজনীতিতে। যোগদান করেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগে। অল্প দিনে পেয়ে যান উপজেলা শাখার সহসভাপতির দায়িত্ব।
অবশ্য হানেফ আলীর ছোট ভাই হরিণাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান বলেন, তাঁর ভাই রাজনৈতিক কারণে একাধিক মামলার আসামি হয়েছিলেন। সব মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলেন। তারপরও শুক্রবার রাতে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।