আলো দেখাচ্ছেন দৃষ্টিহীন তরুণ 

নিজ কার্যালয়ে ফয়সাল মোহাম্মদ। সম্প্রতি নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথায়ছবি: জুয়েল শীল

ঘরে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছেন এক তরুণ, তবে তাঁর চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে নয়। পুরো মনোযোগ কানে ভেসে আসা শব্দে। প্রতিটি শব্দ শুনে শুনে তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন। জানালেন, তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও এই অনুবাদের কাজ করেই মাসে আয় করছেন তিন লাখ টাকা।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁওয়ের বাসায় কথা হয় ফয়সাল মোহাম্মদ নামের এই তরুণের সঙ্গে। ফয়সাল জানান, মাত্র ৯ মাস বয়সেই তিনি দৃষ্টি হারিয়েছেন। দৃষ্টিহীনতার কারণে মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা বাধার। তবে তিনি দমে যাননি। এসব বাধা জয় করেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। হয়েছেন অনুবাদক ও উদ্যোক্তা। 

ফয়সাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ফয়সালের জন্ম হয়েছিল বাবার কর্মস্থল সৌদি আরবে, ১৯৯৬ সালে। জন্মের তিন মাস পর তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হন। সৌদির এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফয়সাল তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান। 

জানতে চাইলে ফয়সাল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নানা বাধা পেরিয়ে আমি খুব বেশি সফল হয়েছি, এমন নয়। তবে আমার মনোবল ছিল। একবারের জন্যও মনোবল হারাইনি। কারণ, মনোবল থাকলে সব বাধা জয় করা সম্ভব।’

শুরুটা যেভাবে 

ফয়সালের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তাঁর পরিবার সৌদি আরব থেকে রাঙ্গুনিয়ায় ফিরে আসে। সেখানেই শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর। প্রথমে ভর্তি হন স্থানীয় এক মাদ্রাসায়, তবে সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। পরে কিছুদিনের মধ্যে ভর্তি হন চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টি ও বাক্-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। সেখানেই চলে তাঁর পড়াশোনা। শ্রুতলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন মাধ্যমিক। পরে ভর্তি হন নগরের সরকারি সিটি কলেজে। এরপর ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, আর পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সহপাঠী রিয়াজুদ্দিন সাব্বিরের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়ে জানতে পারেন। এরপর তিনি অনলাইনে কাজ শেখেন। এরপর ২০২১ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি লায়নব্রিজে অনুবাদক হিসেবে কাজের সুযোগ পান ফয়সাল। এখনো সেখানেই কাজ করছেন।

অনুবাদক থেকে উদ্যোক্তা

ফয়সাল চলতি বছর ১ মে নগরের কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ট্রাভেল এরিনা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁর সেই পুরোনো সহপাঠী রিয়াজুদ্দিন সাব্বির আর সায়েদ মিনহাজ নামের এক ব্যক্তিসহ এ কার্যক্রম শুরু করেন। 

ফয়সাল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান নতুন, তবে তিনজনেরই রয়েছে উদ্যমী মনোবল। এ প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা জানি, মনোবল ঠিক থাকলে আমরা সফল হবই।’

নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ফয়সালের। তাঁরাও যেন নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী আয় করতে পারেন, উদ্যোক্তা হতে পারেন, সেটিই রয়েছে তাঁর পরিকল্পনায়। তবে অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানেন না। আবার ভাষাগত দক্ষতাও নেই। তাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না বলে জানান ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের শেখাতে বিশেষ সফটওয়্যার, প্রশিক্ষণকক্ষ ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। এসবের লজিস্টিক সহায়তা না থাকায় আপাতত উদ্যোগটি এগিয়ে নিতে পারছি না। তবু হাল ছাড়ছি না। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’

ফয়সালের ব্যবসায়িক সহযোগী ও ট্রাভেল এজেন্সির প্রধান নির্বাহী সায়েদ মিনহাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফয়সাল আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর দৃঢ় মানসিকতা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁর থেকে শিখছি। ব্যবসার অনেক পরিকল্পনা ফয়সাল করেছেন।’