ঝড়ে ছুটতে হয় আশ্রয়কেন্দ্রে

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের প্রায় সবাই জলাবায়ু উদ্বাস্তু। তাঁদের এলাকার বেহাল রাস্তাঘাট। নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ও।

কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরাটেক উপকূলের একটি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক পাড়া। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এই ওয়ার্ড। সেখানে ছোট-বড় ৭০০টি শুঁটকিমহাল। এখানে কাজ করেন প্রায় ৪৭ হাজার নারী-পুরুষ। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার শ্রমিকের বাড়ি একই জেলার কুতুবদিয়া উপজেলায়। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারিয়ে এসেছেন জেলা সদরে। বছরের পর বছর চলে গেলেও হয়নি স্থায়ী ঠিকানা। মাথা গোঁজার বসতঘরের অবস্থাও নাজুক। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে হয়।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডটি ১৭টি গ্রাম-মহল্লা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে নাজিরারটেক, কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া, ফদনার ডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বন্দর পাড়া, বাসিন্যাপাড়া। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অধিকাংশের ঠাঁই হয়েছে এসব পাড়ায়।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর ভাঙনের শিকার হওয়া কুতুবদিয়ার লোকজন শুধু জেলা সদরে নয়, আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের চকরিয়া, ডুলাহাজারা ও মালুমঘাট এলাকায়ও। তাঁদের বসতি গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম, বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায়ও। এসব পাড়ার নামও হয়েছে ‘কুতুবদিয়া পাড়া’। কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও অভাব-অনটন যেন নিত্যসঙ্গী। আছে প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান–আতঙ্ক।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কক্সবাজারের খুরুশকুলে পাঁচতলার ১৩৭টি ভবন করছে সরকার। সেখানে ঠাঁই হবে ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের ২০ হাজার হতদরিদ্র মানুষের। তবে আরও সাড়ে তিন হাজার পরিবার স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।

খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য প্রথমে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ২১টি তালিকায় ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের একটি তালিকা হয়েছিল। এখন তালিকা থেকে অনেকের নাম বাদ পড়ছে, কেউ কেউ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। এ নিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
জহির আহমদ, সভাপতি, মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়া সমাজ কমিটি

সংকটে বিপর্যস্ত জনপদ

সম্প্রতি পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে জেলা সদরে আসা এসব মানুষের জন্য ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এখনো অধিকাংশ বাসিন্দা থাকেন বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরে। রাস্তাঘাট বেহাল থাকে বছরজুড়ে। নালা-নর্দমা, জলাশয় ও খালে ময়লা-আবর্জনা ভাসে। আছে মশার উৎপাত। হাট-বাজারগুলোর অবস্থা শোচনীয়। পশ্চিম ও উত্তর দিকে বেড়িবাঁধ না থাকায় সমুদ্রের লোনা পানিতে প্লাবিত হয় শত শত ঘরবাড়ি। সর্বশেষ গত বছরের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে লন্ডভন্ড হয় এই ওয়ার্ডের অন্তত পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি।

শুধু তা–ই নয়, পুরো ওয়ার্ডটিতে নেই কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার কারণে শিশু-কিশোরদের পড়াশোনা থেমে যায় মাঝপথে। স্বাস্থ্যসেবার জন্যও নেই কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে স্বামী সৈয়দ আলমকে হারান কুতুবদিয়া উপজেলার খুদিয়ারটেকের বাসিন্দা হাসিনা বেগম (৫৫)। এর কিছুদিন পর ৩ মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে চলে আসনে কক্সবাজারের ১ নম্বর ওয়ার্ডে। মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়ার এক খণ্ড সরকারি জমিতে ঝুপড়ি তৈরি করে এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি। তিনি বলেন, বৈরী পরিবেশের কারণে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ থাকে। এ কারণে অধিকাংশ শুঁটকিমহালে কাজ থাকে না। এ সময় ধারদেনা করে সংসার চালান।

শুঁটকিমহালের নারী শ্রমিক সাবেকুন্নাহারের স্বামী সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন ১১ বছর আগে। কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল থেকে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আসনে কক্সবাজার শহরে। তিনি বলেন, সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক অর্থাৎ ৩৫০ টাকা। এ টাকায় সংসার চলে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় এক ছেলে এক মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ।

শুঁটকিমহাল এলাকায় শিশুদের পাঠদানের জন্য ২০২২ সালে নাজিরারটেক উপকূলে ৩০টির বেশি ‘শিখন’ স্কুল করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা—স্কাস। সংস্থাটির চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা বলেন, বর্তমানে শিখন স্কুলে পড়ছে ১২ হাজার ৩০০ শিশু। যাদের অধিকাংশ আগে শুঁটকিমহালে যেত।

তাদের একজন আবুল মনছুর (৯)। সে জানায়, আগে সে মায়ের সঙ্গে শুঁটকিমহালে যেত। মাছ ধোয়ার কাজ করত। এক বছর ধরে সে মহালে যাচ্ছে না।

শুঁটকিমহাল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন নাজিরারটেক বহুমুখী মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা ৯৭১ জন। নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য প্রসঙ্গে সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ বলেন, নারীরা পুরুষের মতো ভারী কাজ করতে পারেন না। এ কারণে বেতনও কম দেওয়া হয়।

পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে একটি বেসরকারি বিদ্যালয় উদ্বোধন হয়েছে। রাস্তাঘাটও ঠিক করা হবে।

এখন একটি ফ্ল্যাটের আশা

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর পূর্ব পাশে খুরুশকুল এলাকায় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে সরকার। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প।

এখানে বিনা মূল্যে ঠাঁই পাবেন জলবায়ু উদ্বাস্তু ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার দরিদ্র মানুষ। ২০২০ সালের ২৩ জুলাই প্রথম ধাপে ২০টি ভবনে ফ্ল্যাটবাড়ি পেয়েছেন ঝুপড়িতে থাকা ৬০০ পরিবার। এসব পরিবারের মধ্যে আছেন ভিক্ষুক, জেলে, শুঁটকিশ্রমিক ও দিনমজুর।

কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য সম্প্রতি বাঁকখালী নদীর ওপর ৫৯৬ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর উদ্বোধন করেন।

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে জলবায়ু উদ্বাস্তু লোকজনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন নিয়ে প্রশিক্ষণ ও অর্থসহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন।

সংস্থার প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এটি পৃথিবীর প্রথম জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প, যা একমাত্র বাংলাদেশে করে দেখাতে পেরেছে।

খুরুশকুলের বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত ৬০টি ভবনে ঠাঁই পেতে জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে।

আকতার কামালের বাড়িতে কথা হয় মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা নাজির আহমদের (৭৩) সঙ্গে। তিনি বলেন, সাগরের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এরপর শুঁটকিমহালে কাজ করে কোনো রকম সংসার চালিয়েছেন, এখন বেকার। একটি স্থায়ী ঘর পেলে খুব উপকার হবে।

মধ্যম কুতুবদিয়া পাড়া সমাজ কমিটির সভাপতি জহির আহমদ (৬৩) বলেন, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য প্রথমে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ২১টি তালিকায় ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের একটি তালিকা হয়েছিল। এখন তালিকা থেকে অনেকের নাম বাদ পড়ছে, কেউ কেউ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। এ নিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।