দিনমজুরের কাজ করে সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন হাবিবা 

উম্মে হাবিবা
ছবি: প্রথম আলো

উম্মে হাবিবার বয়স ৫৩ বছর। এ বয়সেও ফুরসত নেই। অন্যের বাড়িতে সারা দিন কাজ করেন। এক যুগ আগে তাঁর স্বামী মারা যান। তখন তাঁর চার সন্তান ছোট। ওই সময় থেকে অভাব–অনটন তাঁর পিছু ছাড়েনি। কিন্তু তিনিও হাল ছাড়েননি। দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে লেখাপড়ার শেখানোর জেদ ছিল তাঁর মনে। দিন-রাত কাজ করে যা টাকা জমিয়েছেন, তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। 

আজ শুক্রবার বেগম রোকেয়া দিবস। বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর এ দিবস পালন করা হয়। বেগম রোকেয়ার মতো বড় পরিসরে না হলেও উম্মে হাবিবা নিজের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। 

হাবিবা রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জাফরপুর গ্রামের বাসিন্দা। গত বুধবার জাফরপুর গ্রামে হাবিবার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এক চিলতে জমিতে টিনের ছোট একটি ঘর। হাবিবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। গ্রামের অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। খবর দিলে তিনি কাজ ফেলে ছুটে আসেন। বাড়িতে বসার কোনো চেয়ারও নেই। পাশের বাড়ি থেকে দুটি চেয়ার এনে বসতে দিলেন। 

হাবিবা বলেন, স্বামীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া মাত্র এক শতাংশ জমির ওপর তাঁর বাড়ি। তাঁর স্বামী সামসুল হক এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। সংসারের খরচ চালাতে তিনি প্রাইভেট পড়াতেন। এই সামান্য টাকা দিয়েই কোনোরকমে সংসার চলত। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালে মারা যান তিনি। রেখে যান চার সন্তান। 

স্বামী মারা যাওয়ার পর কীভাবে সন্তানদের মানুষ করবেন, দুবেলা খাওয়াবেন এই চিন্তায় তাঁর ঘুম আসত না। অবশেষে সংকোচ ভুলে দিনমজুরির কাজে ঝুঁকে পড়েন। সকালে রাস্তার মাটি কাটা শেষে রাতে চাতালে কাজ করেছেন। সেই টাকা দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। সন্তানদের বাড়িতে রেখে এসব কাজ করতে গিয়ে দুশ্চিন্তাও ছিল। কিন্তু তিনি থেমে যাননি।

হাবিবা বলেন, তাঁর স্বামীর ইচ্ছে ছিল সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। স্বামীর সেই ইচ্ছে পূরণ করতে কাজে নেমে পড়েন। তাঁর পরিশ্রমের সম্মান রেখেছে ছেলে-মেয়েরা। বড় মেয়ে শামীমা আক্তার মিঠাপুকুর ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেছে। ছোট মেয়ে রুবাইয়া পারভীন ডিগ্রি পড়ছে। দুই মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে হাবিবুল বাশার উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পুলিশে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে শাহাদত হোসেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। 

উম্মে হাবিবা বলেন, বেগম রোকেয়ার কথা তিনিও শুনেছেন। এই পায়রাবন্দে অনেক নারী নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন। তিনিও তাঁর সাধ্যমতো কাজ করেছেন। এখনো কাজ করছেন। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়। দিনমজুরির কাজ করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। 

হাবিবা আরও বলেন, ‘ঈদের সময় ছেলে-মেয়েদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে আগাম শ্রম বিক্রি করেছি। সে টাকা শোধ দিতে ধীরে ধীরে কাজ করেছি। ছেলে-মেয়েদের মাছ-মাংস খেতেও দিতে পারতাম না।’

পায়রাবন্দ ডিগ্রি কলেজের সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সাবেক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন, বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দে নানা প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার দূর করে নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তেমনি একজন নারী উম্মে হাবিবা। 

পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, হাবিবা শত কষ্টের মধ্যেও চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার।

এদিকে, বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন উপলক্ষে পায়রাবন্দে তিন দিনব্যাপী মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উদ্বোধনী দিন আজ শুক্রবার বিকেলে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রধান আলোচক থাকবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোখলেছুর রহমান।