গ্রামীণ নারীর ভূমির মালিকানা লাগবে, এটা ক্ষমতায়নে সহায়ক

আনোয়ার জাহিদ

অবমূল্যায়ন নয়, পরিবার ও সমাজে গ্রামীণ নারীর অবস্থানের মূল্যায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পরিবর্তনের প্রভাব ও নারীর বহুমাত্রিক ঝুঁকি, এখনই প্রয়োজন জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ’। দিবসটির বিষয়বস্তু নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে সম্মিলিত উদ্‌যাপন কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি ও উন্নয়ন সংগঠক আনোয়ার জাহিদের সঙ্গে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের নারীদের শ্রমক্ষেত্রে বৈষম্যের ধরন কেমন?

আনোয়ার জাহিদ: আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি কাজ করেন গৃহস্থালিতে। কিন্তু এর কোনো স্বীকৃতি নেই। গৃহস্থালির কাজে একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় দেন। একজন পুরুষ এ ধরনের কাজে সময় দেন মাত্র এক ঘণ্টা। এসব কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করানো হলে যে পারিশ্রমিক আসে, তার আর্থিক মূল্য জিডিপির ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ থেকে মোটাদাগে বোঝা যায়, নারীদের শ্রমক্ষেত্রে বঞ্চনা কতটা গভীর।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দেশে কি কোনো প্রচলিত আইন আছে, যা নারীদের শ্রমক্ষেত্রে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দিতে পারে?

আনোয়ার জাহিদ: অবশ্যই আছে। শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারা অনুযায়ী, নারী-পুরুষের সমকাজে সমান মজুরি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। চারা রোপণ ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের দৈনিক মজুরি যেখানে ৩০০-৬০০ টাকা, নারীরা সেখানে পান মাত্র ৩৫০ টাকা। আপাতদৃষ্টে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের কথা মনে হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করানোর সুবিধা। নারীর সোচ্চার না হওয়া ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব মূলত এর জন্য দায়ী। দেশ, পরিবার ও সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য এমন অবস্থার অবসান প্রয়োজন। এ জন্য নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে গ্রামীণ নারীদের।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দেশে কৃষি, শিল্প, মৎস্য, গবাদিপশুর খামারসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। গ্রাম ও শহর, উভয় জায়গাতেই। সে ক্ষেত্রে গ্রামের নারীদের অবস্থা শহরের নারীদের চেয়ে খারাপ?

আনোয়ার জাহিদ: আমরা যদি নারী-পুরুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিকে চোখ ফেরাই, তবে খুব সহজেই দেখা যাবে যে দেশের সব শ্রেণির নারীই নিপীড়ন ও অবহেলার শিকার। তার ওপর গ্রামাঞ্চলের মেয়েশিশু ও নারীরা বেশি মাত্রায় দারিদ্র্য ও নেতিবাচক সামাজিক আচার ও চর্চার শিকার হচ্ছেন। পারিবারিকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের ক্ষমতায়নের অভাব আছে। এটা অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে যে গ্রামের দারিদ্র্যের হার শহর এলাকার তুলনায় বেশি। সামাজিক অঙ্গন, পরিবার, ভূমি, ঋণব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার—কোনোখানেই তাঁদের সমান প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের আইন, নীতি ও সামাজিক চর্চা সম্পত্তিতে নারীর মালিকানার বিষয়টি সমর্থন করে না। গ্রামীণ মেয়েশিশু ও নারীদের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাঁরা পড়াশোনা শেষ করতে পারেন না। চাকরিতে তাঁদের সুযোগ থাকে কম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: করোনা মহামারি মানুষের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নারীর দুরবস্থা কি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে?

আনোয়ার জাহিদ: করোনা মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস হয়েছে। দেশের শিশু ও নারীরা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্যসংকটের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম এবং মেয়েশিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার। নারীদের দায়িত্বের বোঝা বেড়েছে বহুগুণ। অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় গ্রামীণ নারীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই পুরুষ সঙ্গীদের মতো নারীদেরও প্রণোদনা, সহযোগিতা ও আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল। সেটা যথাযথ না হওয়ায় তাঁদের পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নারীদের অবদান কেমন?

আনোয়ার জাহিদ: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা কম নয়। বিশেষ করে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা (ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স) তৈরির ক্ষেত্রে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কী করা উচিত?

আনোয়ার জাহিদ: নারীদের অবস্থার উন্নয়নে পরিষ্কারভাবে জাতীয় নির্দেশিকা, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে লাগবে তার বাস্তবায়ন। নারীর সাক্ষরতার হার বাড়ানো, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। ভূমির মালিকানার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কেননা, দেশের ৯৫ শতাংশ নারীর নিজের জমি নেই। ভূমির মালিকানা নারী ক্ষমতায়নের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ, যা নারীর আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা বাড়াবে। নারীদের ওপর কাজের যে বোঝা, সেটা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।