ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী। শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে
ছবি: প্রথম আলো

সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘আমাদের ধর্ম আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়—এটা বলে ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি সাংস্কৃতিক বিরোধ মেটাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না।’

আজ শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বহু ধর্ম ও মত মিলেমিশে থাকার দেশ। ৫ আগস্টের পর বেশ কিছুদিন দেশে কোনো পুলিশ ছিল না। আমরা দল, মত, ধর্ম, বিশ্বাস না দেখে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি পাহারা দিয়েছি। এটাই বাংলাদেশের স্পিরিট। পতিত ফ্যাসিস্ট আমাদের পাশের দেশে গিয়ে পালিয়ে আছে। সেখান থেকে তারা নানা রকমের ষড়যন্ত্র করছে। সেখান থেকে মন্দিরের হামলার চক্রান্ত তারা করেছিল। সেটা সফল হয়নি, সবাই মিলে পাহারা দেওয়ার কারণে।’

এখনো চক্রান্ত চলছে উল্লেখ করে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশের আনাচকানাচে বাউলশিল্পীরা আছেন। তাঁদের নিয়ে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা চলছে। আপনারা সবাই মিলে এই প্রোপাগান্ডা রুখে দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেন, বাংলাদেশের মানুষ কেমন এবং ইসলাম কতটা সহনশীল। এখন আমাদের সবাই মিলে দেশ গড়ার সময়। আমরা সবাই যেন দায়িত্বশীল হই। একে অন্যের প্রতি সহনশীল হই। যেকোনো বড় রাজনৈতিক ঘটনা একটি সাংস্কৃতিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ। জুলাইয়ের ঘটনা এক দিন-দুই দিনের ঘটনা নয়। এটা মানুষের বহু বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।’

লোককারুশিল্প মেলায় আসা দর্শনার্থীরা। শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে
ছবি: প্রথম আলো

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. মফিদুর রহমান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হেলালউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান ও জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।

উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের প্রখ্যাত দুজন কারুশিল্পীকে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মাননা’ ও তিনজন কারুশিল্পীকে ‘শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার ২০২৪’ প্রদান করা হয়। নকশিকাঁথা শিল্পের জন্য বেগম হোসনে আরা ও তামা-কাঁসা শিল্পের জন্য মানিক সরকারকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে তাঁদের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা ও দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার-২০২৪ পেয়েছেন কোমর তাঁতশিল্পী মিলন চিসিম, চিত্রিত হাতিঘোড়া কারুশিল্পী ধীরেন্দ্র সূত্র ধর ও টেপা পুতুল কারুশিল্পী সুনীল পাল। পুরস্কার হিসেবে তাঁদের প্রত্যেককে এক ভরি ওজনের স্বর্ণপদক ও এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

মেলায় কারুশিল্পীদের কাজ দেখছে এক দল শিশু দর্শনার্থী। শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে
ছবি: প্রথম আলো

মাসব্যাপী মেলায় থাকছে ১০০টি স্টল

প্রতিবারের মতো বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নিজেদের প্রাঙ্গণে এই মেলার আয়োজন করছে। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে ফাউন্ডেশনের মঞ্চে হবে লোকজ উৎসব। মেলায় প্রবেশের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ৫০ টাকা ও শিক্ষার্থীদের ৩০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হবে। বিকেল ৫টার পর মেলায় প্রবেশে কোনো টিকিট লাগবে না।

ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের মেলায় সরাসরি শিল্প সৃষ্টি করে তা প্রদর্শনী ও বিক্রির ৩২টি স্টলসহ ১০০টি স্টল বরাদ্দ করা হয়েছে। সরাসরি শিল্প সৃষ্টি করে তা প্রদর্শনী ও বিক্রির স্টলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খ্যাতনামা ৬২ জন কারুশিল্পী তাঁদের কাজ নিয়ে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া নাগরদোলা, বায়স্কোপ, পুতুলনাচ ও মিঠাই-মণ্ডার পসরা বসেছে মেলা প্রাঙ্গণে।

নিজের কাজ নিয়ে মেলায় অংশ নেওয়া রিকশা পেইন্টার এস এ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উদ্বোধনী দিনে লোকসমাগম বেশি হয়েছে। মেলার প্রচার বাড়লে এ বছর মেলা তুলনামূলক জমে উঠবে বলে আশাবাদী তিনি।

মেলার আয়োজন নিয়ে সোনারগাঁয়ের বাসিন্দা কবি শাহেদ কায়েস প্রথম আলোকে বলেন, লোকজ শিল্প বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। এসব শিল্পে এখন আর অর্থ নেই, সম্মান নেই, জীবিকা নির্বাহের উপায় নেই। ফলে শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্ম শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হচ্ছে না। বাংলাদেশের লোককারুশিল্পীদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের কৃষ্টি, কালচার, কারুশিল্পকে তুলে ধরার জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। প্রতিবছর এখানে মেলা হচ্ছে, মানুষ আসছে। এটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একইভাবে মেলা চলছে। মেলার আয়োজন আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলে মেলা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।