বনরক্ষীদের ঘুষের বলি টেংরাগিরি বনাঞ্চল ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যভান্ডার

টেংরাগিরি বনাঞ্চলের পাশে তিন নদীর মোহনায় অবৈধ খুঁটা জাল দিয়ে চলছে মাছ নিধনের মহোৎসব। গত বৃহস্পতিবার তোলাছবি: প্রথম আলো

বরগুনার তালতলী উপজেলার সংরক্ষিত টেংরাগিরি বনাঞ্চলের বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে বনের গাছ কাটতে দেওয়া এবং বনসংলগ্ন নদীতে অবৈধ খুঁটা জাল দিয়ে মাছ শিকারে সহায়তা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে ঘুষের টাকার দর-কষাকষি নিয়ে বনরক্ষীদের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর সরেজমিনে গিয়ে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

টেংরাগিরি বনাঞ্চলটি সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল। বনটি বরগুনার তালতলী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় বন স্থানীয়ভাবে ফাতরার বন নামে পরিচিত। পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী—দক্ষিণের এই তিন বড় নদ-নদী এখান থেকে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। দেশের নদ-নদীতে সাগর থেকে উঠে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ৬০ ভাগ এখান দিয়ে আসা-যাওয়া করে। এই বনাঞ্চলের ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দূরে গোড়াপদ্মা উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী এবং ৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পাথরঘাটা উপজেলায় হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবস্থিত। বনাঞ্চল থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। মাছের প্রজনন ও চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে শত শত জেলে বন বিভাগকে ম্যানেজ করে ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে প্রতিদিন মাছ ধরায় একদিকে দেশের বিশাল মৎস্যভান্ডার শূন্য হচ্ছে, অপর দিকে হুমকির মুখে পড়ছে শ্বাসমূলীয় এই বনাঞ্চল।

জেলের সঙ্গে বনরক্ষীদের দর-কষাকষির ওই ভিডিওতে দেখা যায়, টেংরাগিরি বনাঞ্চলের নলবুনিয়া বিটের শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতে একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ওই বিটের জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এ সময় তিনি হায়দার মিয়া নামের এক জেলেকে বলেন,‍ ‘ওই দেহি জাল পাতা, দেহি কার, তা পাতা এহন কোলোম কাটতে যামু, কতা সোজা বাংলা।’ উত্তরে ওই জেলে বলেন, ‘মোর জাল উঠাইয়া আনছি, কার তা জানি না।’ এ সময় পাশেই চেয়ারে বসা দেখা যায় নলবুনিয়া বিটের বনপ্রহরী জহিরুল হককে। জহিরুল হক বলেন, ‘ও (জেলে) কইতে আছে কি জানেন, আমাগো টাকা দেছে পনের শ।’ জাহাঙ্গীর হোসেনকে এ সময় বলতে শোনা যায়, ‘তুই (জেলে) কার কাছে টাকা দেছ? কিসের টাকা?’ উত্তরে ওই জেলেকে বলতে শোনা যায়, ‘জাল পাতি এই জন্য টাকা দিছি। প্রথমে আলমগীর ভাইয়ের হাত দিয়ে দিছি এক হাজার, পরে উত্তম বাবু (নলবুনিয়া বিটের বাগানমালি) হে আনছে ৫০০।’ এ সময় জাহাঙ্গীর হোসেন ওই জেলেকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘কথা বুজতে পারছ, এহোন এই সিজনে (মৌসুম) টাকা দেবা দুই হাজার, তা হইলে জাল পাতবা, না হইলে কথা এক্কেবারে কাটছিট।’

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীর হোসেন বন বিভাগের কেউ নন। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা ও বন বিভাগের হয়ে ঘুষের টাকা সংগ্রহ ও দেনদরবার করেন। ঘুষ নিয়ে দেনদরবার করা ব্যক্তি হায়দার মিয়া পেশায় জেলে। তিনি নলবুনিয়া এলাকার আবদুল হাই মিয়ার ছেলে। কথোপকথনের বিষয়ে হায়দার মিয়ার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারমু না। তাইলে বন বিভাগের স্যারেরা আমারে মামলায় ফাঁসাইবে।’

স্থানীয় অন্তত সাতজন জেলে জানান, এই বনসংলগ্ন তিন নদ-নদীতে কয়েক শ জেলে ছোট ফাঁসের খুঁটা জাল দিয়ে মাছ ধরেন। এ জন্য জেলেরা এই বনের গাছ কেটে এসব জালের খুঁটা তৈরি করেন। এ জন্য প্রত্যেক জেলেকে জালপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বনরক্ষীদের। তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া বিট কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।

টেংরাগিরি বনাঞ্চলের গাছ কেটে এভাবে সাবাড় করা হচ্ছে বন। নলবুনিয়া এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ওই ব্যক্তিরা জানান, বন রক্ষা যাঁদের দায়িত্ব, সেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বন রক্ষার নামে বনের গাছ বিক্রি থেকে শুরু করে বনের ভেতরে গবাদিপশু চরানোর অনুমতি দিয়েও অর্থ আদায় করেন। প্রতিটি গবাদিপশু চরাতে মালিকদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা নেওয়া হয়। বনে কয়েক হাজার গরু-মহিষ চরানো হচ্ছে। এ ছাড়া গাছচোরদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে অবাধে চুরিতে সহায়তা করারও অভিযোগ আছে। এভাবে বন ঘিরে চলছে তাঁদের ভয়াবহ বাণিজ্য।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদ-নদীর মোহনায় শুভসন্ধ্যা সৈকতে অসংখ্য অবৈধ খুঁটা জাল পেতে রেখেছেন জেলেরা। এ জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ছোট গাছ কেটে খুঁটি হিসেবে পুঁতে রাখতে দেখা যায় তাঁদের। সৈকত থেকে বনের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, গরু ও ছাগলের পাল। এগুলো বনের ছোট ছোট চারা গাছ খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। বনের ভেতরে ঢুকে আরও দেখা যায়, বড় গাছ কেটে নেওয়ার পর গোড়া পড়ে আছে। গাছ কেটে নেওয়ার এমন দৃশ্য চোখে পড়ে বনের বিভিন্ন জায়গায়।

টেংরাগিরি বনাঞ্চলের গাছ কেটে এভাবে সাবাড় করা হচ্ছে বন। নলবুনিয়া এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বেশ কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নদীতে জাল পাততে হলে প্রতিবছর বনরক্ষী জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে বন বিভাগকে টাকা দিতে হয়। আগে প্রতি মৌসুমে ১ হাজার টাকা দিতে হতো। এখন প্রতি মৌসুমে ২ হাজার টাকা করে বছরে দুই মৌসুমে চার হাজার টাকা দিতে হয়। নদীতে মাছের পরিমাণ কমলেও প্রতিবছর বাড়ে তাঁদের ঘুষের পরিমাণ। সময়মতো টাকা পরিশোধ না করলে বনরক্ষী জাহাঙ্গীর হোসেন জাল কেটে দেন।

ভিডিওতে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুভসন্ধ্যা ঘাটলা–সংলগ্ন এলাকার নদীতে অবৈধ জাল পাতায় আমরা জালগুলো কেটে দিয়েছি। এখন সেই বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনটা করা হচ্ছে।’ ভিডিওতে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই ভিডিও এডিট করা। জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে জাল কেটে দিয়েছি আমরা। টাকা নেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। তবে আমি বন বিভাগে চাকরি করি না। লোকবল কম থাকায় তাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করি।’

নলবুনিয়া বিটের বনপ্রহরী জহিরুল জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে বলেন, তাঁর সঙ্গে এক জেলের তর্ক হয়েছে। তিনি কোনো টাকা নেননি। তালতলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি অভিযোগ পাই, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’