সত্যকে তুলে ধরার জন্য প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা সব সময় ঘটনার কাছাকাছি থাকেন। গুজবে কান দেন না, যা দেখেন তা–ই লেখেন। প্রথম আলো সব সময় সত্যের সন্ধান দেয়। প্রথম আলো এমন একটি সংবাদপত্র, যা প্রয়োজন প্রতিটি দিনের জন্য, প্রতিটি মুহূর্তের জন্য।
শুক্রবার বিকেলে বগুড়ায় প্রথম আলো আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। পত্রিকাটির ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার হোটেল লাভিস্তার হলরুমে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একই সময়ে ফরিদপুরে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে রাজনীতিক, শিক্ষক, কবি-সাহিত্যিক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। দুটি অনুষ্ঠানেই সহায়তা করেন বন্ধুসভার বন্ধুরা।
বগুড়া
বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকী সড়কে হোটেল লাভিস্তার হলরুমে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সুধী সমাবেশ শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এবং সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার পারভেজ।
অতিথিদের মধ্যে বক্তব্যে রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নদী গবেষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘প্রথম আলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখার চেষ্টা করেছে। তারা ঘটনার কাছাকাছি থেকে আন্দোলনকারীদের দমন–নিপীড়নের ভেতরের খবর তুলে আনার চেষ্টা করেছে। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যা ঘটেছে, তা নিজেরা দেখে সেই সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন।’
কবি ও কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার বলেন, ‘প্রথম আলো সব সময় সত্যের সন্ধান দেয়। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে প্রথম আলোকে আগেও যেমন সাহসী দেখেছি, ভবিষ্যতেও সত্য তথ্য প্রকাশে সাহসী দেখতে চাই। প্রথম আলো পাঠক সংখ্যাতেও প্রথম, সেরাতেও প্রথম, সত্যেও প্রথম।’
পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য চিত্তরঞ্জন মিশ্র তাঁর বক্তব্যে বলেন, গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম শর্ত হলো স্বাধীন গণমাধ্যম। এ স্বাধীন গণমাধ্যম এ দেশে হাতে গোনা। এর মধ্যে অন্যতম প্রথম আলো। প্রথম আলোর সঙ্গে থাকা মানেই সত্যের সঙ্গে থাকা।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও বগুড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র রেজাউল করিম বাদশা সুধী সমাবেশে বলেন, প্রথম আলো এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলার কারণ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ। কোনো একক দল বা গোষ্ঠীর নয়, প্রথম আলো যেন হয় সবার কাগজ।
প্রথম আলো গুজব ছড়ায় না বলে উল্লেখ করেন বগুড়া-৪ (কাহালু) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বগুড়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন। ভবিষ্যতেও তিনি এ ধরনের সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করেন।
প্রথম আলোকে পরিপূর্ণ খবরের কাগজের ‘প্যাকেজ’ হিসেবে উল্লেখ করেন বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার। ছোট শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী এ কাগজে লেখা থাকে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে প্রথম আলো শুধু খবরের কাগজ নয়, পরিবারের সঙ্গী।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বগুড়া শহর শাখার সেক্রেটারি আ স ম আবদুল মালেক বলেন, প্রথম আলো সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সাংবাদিকতা করেই ২৭ বছরের পথচলা শেষ করে এ পর্যন্ত এসেছে। আগামীতেও সত্যের সঙ্গে প্রথম আলো এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে।
বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুহা. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেকোনো বইয়ের সূচিপত্র দেখলে যেমন বোঝা যায় ভেতরে কী আছে, তেমনি সকালবেলা প্রথম আলো খুললে বোঝা যায়, গোটা বাংলাদেশে এবং বিশ্বে কী ঘটেছে।
সুধী সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রেজাউল হাসান, টিএমএসএসের উপনির্বাহী পরিচালক মতিউর রহমান, হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া অঞ্চলের পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. শহিদ উল্লাহ্, বগুড়া জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ার, বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী রফিকুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বগুড়া জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত ইমরান, পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের বগুড়া জেলা কমিটির সহসভাপতি এমদাদ আহমেদ, বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির যুগ্ম পরিচালক আবদুল মজিদ, সরকারি আজিজুল হক কলেজের সহকারী অধ্যাপক শফি মাহমুদ, জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের বাবা মাহবুব হামিদ (তারা), বগুড়ার নারী উদ্যোক্তা তহমিনা পারভীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ সময় পাঠকেরা প্রথম আলোর কাছে তাঁদের প্রত্যাশাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. শহিদ উল্লাহ্, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক জিয়াউল ইসলাম, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরে আলম সিদ্দিকী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ডিজিএম শাহিনুর ইসলাম, সুজনের জেলার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন ইসলাম।
পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে স্বাধীন সাংবাদিকতা হয় না। স্বাধীন সাংবাদিকতা না থাকলে সরকারও সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। সত্য সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিল প্রথম আলো। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলা-হামলা হয়েছে। বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়াও নানাভাবে প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম আলো সাহসী সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনো পিছপা হয়নি।
পাঠকের আস্থাই প্রথম আলোর ভিত্তি উল্লেখ করে লাজ্জাত এনাব মহছি বলেন, ‘এই আস্থা সাহসী সাংবাদিকতা করে অর্জন করতে হয়েছে। পাঠকই প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকতার শক্তির উৎস। পাঠকেরা সব সময় প্রথম আলোর পাশে থেকে সাহস দিয়েছেন। পাঠকের ভালোবাসার কারণেই এ বছর আমরা দুটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছি। এই অর্জন প্রথম আলোর পাঠকদের জন্যই সম্ভব হয়েছে।’
ফরিদপুর
ফরিদপুরে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে বিকেল চারটায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। প্রথম আলো ফরিদপুর বন্ধুসভার উপদেষ্টা শিপ্রা গোস্বামীর সঞ্চালনায় এতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলো ফরিদপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক প্রবীর কান্তি বালা। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হয়। এরপর বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদ।
অতিথিদের মধ্যে বক্তব্যে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সোহরাব হোসেন বলেন, ‘প্রথম আলোর নামটা প্রথম যেদিন শুনি, তখন ভেবেছিলাম নতুন কিছু আসবে। আলপিন সরিয়ে দেওয়াটা ভালো হয়নি। এটা দরকার। প্রথম আলোর কিছু পরিবর্তন আমরা চাই নাই, পছন্দ করি না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রথম আলোর প্রচেষ্টাও অনন্য। প্রথম আলো এ চেষ্টা করে যেতেই থাকুক।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তরুণ ও কৃষকদের জন্য যেন প্রথম আলো কিছু করে। সমুদ্রের তলদেশে অনেক মণিমাণিক্য থাকলেও জেনেও আমরা তা তুলে আনতে পারি না। তরুণেরা যেন ফোটার আগে ঝরে না যায়।’
ভাঙ্গা কে এম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোশায়েদ ঢালী বলেন, প্রথম আলো স্বাধীনতার পক্ষে। একাত্তরের স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে বাংলাদেশ থাকবে না। তাই প্রথম আলো চিরজীবী হোক, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
প্রথম আলোকে ‘ঠোঁট কাটা’ হিসেবে উল্লেখ করে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘পত্রিকাটি কোনো দিন সরকারের প্রিয় হতে পারে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের একটা পাটাতন করে যেতে হবে। সেটা করতে পারে প্রথম আলো।’
জেলা জামায়াতের আমির বদরউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকদের বলি কলমযোদ্ধা। দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিস্টের অধীনে ছিলাম। সেখানে আমরা প্রতিবাদী হতে পারলে আমাদের এমন জিম্মি হয়ে থাকতে হতো না।’
সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রফিকুজ্জামান বলেন, ‘মফস্সলের খবর অনেক সময় চলে যায় নগর সংস্করণে। আমরা ফরিদপুরে বসে সে নিউজ পড়ার সুযোগ পাই না।’
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ফরিদপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি আওলাদ হোসেন, সাহিত্যিক আলতাফ হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা কাজী জেবা তাহসিন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এফডিএর পরিচালক আজহারুল ইসলাম।
প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন গ্রামীণ উন্নয়ন প্রতিবন্ধী সংস্থার বিপ্লব কুমার মালো, সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান চৌধুরী, জেলা কালচারাল অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ বি এম সাইফুর রহমান, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চৈতন্য চন্দ্র দাস, কবি আলমগীর কবির, নাট্যকর্মী তন্ময় সরকার, সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলাম, শিক্ষক শেখ নুরুল, টিআইবির সমন্বয়কারী গোলাম মোস্তফা, ক্রীড়া সাংবাদিক মানিক দাস প্রমুখ।
সুধীজনদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেন প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদ। তিনি বলেন, প্রথম আলো সব সময় সরকারি রোষানলের মধ্যে থেকেও কাজ করে যাচ্ছে। কখনো এ পত্রিকাকে বিএনপির সমর্থক, কখনো আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে গালি দেওয়া হয়। সরকারি রোষানলে পড়ার জন্য বিজ্ঞাপন বন্ধ করে প্রথম আলোর কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়। তারপরও প্রথম আলো তার নিজস্ব লক্ষ্যে অটুট থেকে কাজ করে যাচ্ছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখবে।