চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শান্ত ও মেধাবী মুখটি আজ বাংলাদেশের গবেষণা জগতের গর্ব। তিনি ড. রুদ্রপ্রতাপ দেবনাথ, একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, উদ্ভাবক ও গবেষণার নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তাঁর চোখে প্রযুক্তি কোনো যন্ত্রের খেলা নয়—এটি যুক্তি, সৃজনশীলতা ও মানবকল্যাণের এক জীবন্ত রসায়ন।
জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার গ্রামে। বাবা স্বর্গীয় দুলাল কান্তি দেবনাথ, মা নিভা নাথ। বাবা চাকরি করতেন রাঙামাটির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সেই সুবাদে পাহাড় ও হ্রদবেষ্টিত রাঙামাটিতে কেটেছে শৈশব। যেখানকার প্রকৃতি ও মানুষের সরলতা তাঁর চেতনায় বুনেছে গভীর মানবিকতা। এই শিশু খুব শিগগির অনুভব করেছিলেন—জীবন কেবল দেখা নয়, বুঝে ওঠাও এক ধরনের অনুসন্ধান। সেই অনুসন্ধানের পথই তাঁকে পৌঁছে দেয় প্রযুক্তির জগতে, যেখানে যুক্তি আর কল্পনা হাত ধরাধরি করে চলে।
রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ২০০০ সালে এসএসসি ও রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। এরপর রুদ্র প্রতাপ ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। সেখান থেকেই অর্জন করেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি; কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। জ্ঞানের তৃষ্ণা তার মেটেনি। জাপানের মর্যাদাপূর্ণ মেক্সট স্কলারশিপ পেয়ে ২০১২ সালে সম্পন্ন করেন মাস্টার্স। তারপর ‘ইরাসমাস মানডাস’–এর বৃত্তিতে ডেনমার্কের আলবর্গ ইউনিভার্সিটি ও স্পেনের পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অব কাতালোনিয়া থেকে ২০২০ সালে অর্জন করেন ডুয়েল পিএইচডি।
এই দীর্ঘ একাডেমিক অভিযাত্রায় রুদ্রপ্রতাপ খুঁজে পেয়েছেন এক বৃহত্তর লক্ষ্য—কীভাবে ডেটাকে অর্থবহ জ্ঞানে রূপান্তর করা যায় এবং সেই জ্ঞান কীভাবে সমাজ, পরিবেশ ও নীতিনির্ধারণে কাজে লাগানো যায়, তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডেটা সায়েন্স, পরিবেশের স্থায়িত্ব (এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি), সেমান্টিক ওয়েব, নলেজ গ্রাফ ও ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি কেবল পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নন; বরং ‘বিগ ডেটা ইনফরমেশন অ্যান্ড নলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং’ (বিআইকেই) নামের একটি গবেষণাগার পরিচালনা করছেন। এই গবেষণাগারে তরুণ গবেষকেরা প্রতিদিন প্রযুক্তির অজানা দিগন্তে পদচারণ করছেন। এই গবেষণাগারের কাজ শুধু গবেষণাপত্রে সীমাবদ্ধ নয়; বরং দেশের কৃষি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নীতিনির্ধারণ খাতে বাস্তব প্রয়োগের পথও তৈরি করছে। ‘বাংলাদেশের কৃষিতথ্যের ওপর ভিত্তি করে নলেজ গ্রাফ নির্মাণ ও বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ সক্রিয়করণ (নলেজ গ্রাফ জেনারেশন অ্যান্ড এনাবলিয় মাল্টিডাইমেনশনাল অ্যানালিটিকস অন বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ডেটা) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে। এ গবেষণায় ১৯৬৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য ও বনজ সম্পদ–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি হয়েছে বিডিএকেজি নামের এক বিশাল নলেজ গ্রাফ। এই ডেটাকে যুক্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক একসিওবেজ লাইফ সাইকেল অ্যাসেসমেন্ট নলেজ গ্রাফের সঙ্গে। এটির মাধ্যমে পণ্যের কার্বন নিঃসরণ হিসাব করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, গম, সয়াবিন, চা, আদা ও অড়হরের মতো ফসলের ওপর নির্ভর করে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে। তাঁর বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছে—বাংলাদেশের কৃষি শুধু অর্থনীতির নয়, পরিবেশেরও পুনর্জাগরণের ক্ষেত্র হতে পারে। এ গবেষণার জন্য তিনি পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বেস্ট রিসার্চ পেপার অ্যাওয়ার্ড ২০২৪।
এখন রুদ্রপ্রতাপ একটি বড় প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রকল্পটির নাম বিডিএআই (লেভারেজিং বাংলাদেশ সেক্টরাল নলেজ গ্রাফ অ্যান্ড লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলস ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ড্রাইবেন ইনসাইটস)। এটি বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এইচইএটি (হিট) প্রকল্পের অধীন অ্যাওয়ার্ডেড একটি উপপ্রকল্প। এর লক্ষ্য হলো এমন একটি এআইভিত্তিক অবকাঠামো তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, পরিবেশ, জ্বালানি ও অর্থনীতির ডেটাকে বোধগম্যভাবে যুক্ত করবে।
ড. রুদ্রপ্রতাপের দৃষ্টিতে এআই কোনো দূরবর্তী যন্ত্রমানবের স্বপ্ন নয়; বরং এটি এক মানবিক বিপ্লব, যেখানে প্রযুক্তি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে সহায়তা করে। তাঁর মতে ‘আমাদের এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ডেটা হবে মানবকল্যাণের ভাষা।’
রুদ্রপ্রতাপ দেবনাথের জীবন যেন যুক্তি ও কল্পনার সংলাপ। রাঙামাটির হ্রদে প্রতিফলিত জলে যে শিশুর চোখ একদিন আকাশ খুঁজেছিল, সেই চোখ আজ ডেটার মহাবিশ্বে খুঁজছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে।