চুয়াডাঙ্গা
দূষণে অস্তিত্ব–সংকটে মাথাভাঙ্গা
মাথাভাঙ্গা নদীর ৭২ দশমিক ৬৪০ কিলোমিটার চুয়াডাঙ্গার মধ্য দিয়ে গেছে। ময়লা, পশুর বর্জ্য ফেলায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।
ভয়াবহ দূষণে চুয়াডাঙ্গার প্রধান নদী মাথাভাঙ্গা অস্তিত্ব-সংকটে পড়েছে। নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দা এবং নদীতীরবর্তী হাটবাজারের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় নদীর পানি দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সদর উপজেলা প্রশাসন নদীতে ময়লা ফেলা নিষেধাজ্ঞা-সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙালেও ময়লা-আবর্জনা ফেলা এখনো বন্ধ হয়নি। এখনই উদ্যোগ না নিলে একসময়ের স্রোতস্বিনী নদীটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা জানান, মাথাভাঙ্গা বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্ত নদী। পদ্মার অন্যতম প্রধান এ শাখানদীর উৎপত্তি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জলাঙ্গী নদীর ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে। নদীটি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা হয়ে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ১৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর ৭২ দশমিক ৬৪০ কিলোমিটারই চুয়াডাঙ্গা জেলায় পড়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া হয়ে নদীটি এ জেলায় প্রবেশ করে দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা-জয়নগর হয়ে আবার ভারতে চলে গেছে।
পাউবোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গায় মাথাভাঙ্গা নদীর গড় প্রশস্ততা ৯৫ মিটার। বর্ষা মৌসুমে পানির গড় গভীরতা থাকে ৯ দশমিক ৫০ মিটার। শুষ্ক মৌসুমে গড়ে তা ১ দশমিক ২৫ মিটারে নেমে আসে। তখন নদীর অনেক স্থান শুকিয়ে যায়। ফলে নদীতে নৌ চলাচলের কোনো অবস্থা থাকে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা তাঁদের দৈনন্দিন ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে নদীকেই বেছে নিয়েছেন।
সদর উপজেলার দৌলাতদিয়ার সরদারপাড়ার বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘একসময় এই নদীর পানিতে আমার মা-চাচিরা রান্নাবান্না করতেন, নদীর পানি আমরা খেতাম। এখন এতটাই নোংরা যে গোসল করতেও ভয় পাই।’
মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার সভাপতি হামিদুল হক মুন্সী বলেন, ‘কে দায়ী, তা বড় কথা নয়। মাথাভাঙ্গা নদী রক্ষায় আমরা আন্দোলন করছি। এই নদীর সঙ্গে আমাদেরও অস্তিত্বের সম্পর্ক। আমরা বিশ্বাস করি, নদী বাঁচলেই আমরা বাঁচব। তাই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম মালিক দাবি করেন, নদীতে বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা ফেলার একটা সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর তা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। সুমিরদিয়া এলাকায় বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরির পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে পৌর এলাকার পুরো ময়লা-আবর্জনা সেখানে পাঠানো হচ্ছে। তবে নদীর ধার বাজারের ময়লা-আবর্জনা এখনো শতভাগ পাঠানো সম্ভব হয়নি। দোকানদারেরা বিক্ষিপ্তভাবে নদীর ধারে ফেলছেন। তা ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় নোংরা পানি নদীতেই ফেলতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান বলেন, মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভৈরব, কুমার, চিত্রা ও নবগঙ্গা নদ-নদীর সংযোগ রয়েছে। যদি মাথাভাঙ্গা নদী না বাঁচে, তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এসব নদ-নদী বাঁচবে না। নদ-নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় দখল ও দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম ভুইয়া বলেন, গত বছরের ১ আগস্ট মাথাভাঙ্গা নদীতে ব্যাপক মাছের মড়ক দেখা দেয়। এ ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি নদীতে নেমে তলদেশে কাঁথা-বালিশ থেকে শুরু করে আসবাবের ভাঙা অংশসহ পচা আবর্জনার বড় একটি স্তরের অস্তিত্ব পায়। শহরের বর্জ্য যাতে নদীতে পড়তে না পারে, সে জন্য তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে পৌরসভার নালার মুখে লোহার নেট দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পাউবো চুয়াডাঙ্গার পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহমেদ বলেন, মাথাভাঙ্গার শাখানদীগুলো পুনরায় খননের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এবার মাথাভাঙ্গা নদী দিয়ে সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনা আছে। শিগগিরই এ নিয়ে কাজ শুরু হবে।