খুলনার উপকূলীয় এলাকায় অধিকাংশ জমি লবণাক্ত। বৃষ্টির পানিতে কমে যায় সেই লবণাক্ততা। এ সুযোগে আমন ধান আবাদ করেন কৃষকেরা। এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাঁদের। জমি ফেলে না রেখে নদীর ‘নোনা’পানি দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছেন। আর যাঁদের নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ নেই, তাঁরা ব্যবহার করছেন ভূগর্ভস্থ পানি।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আমন চাষের জন্য যে পরিমাণ বৃষ্টির পানির প্রয়োজন, তা এবার হয়নি। বর্তমানে নদীর পানির নোনাভাব কিছুটা কমে গেছে। তাই কৃষকদের নদীর পানি তুলে আমন আবাদ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে যে পরিমাণ লবণাক্ততা রয়েছে, তা দিয়ে কৃষিকাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ কম। গত ৮ মাসে বৃষ্টি হয়েছে ৬৬৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে, অর্থাৎ জুন, জুলাই ও আগস্টে বৃষ্টি হয়েছে ৩৭৯ মিলিমিটার। যেখানে ওই তিন মাসে গড়ে বৃষ্টি হয় সাড়ে ৫০০ মিলিমিটারের মতো। আগামী এক মাসের মধ্যে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপকূলীয় এলাকার জমি থেকে তাঁরা একটি ফসলই পান, আর তা হলো আমন ধান। সারা বছরই ওই একটি ফসলের জন্যই তাঁদের নির্ভর করে থাকতে হয়। ওই ফসল না লাগালে জমি পড়ে থাকবে। ঘরে খাবার জুটবে না। তাই কৃষক নদীর পানি তুলে জমি চাষাবাদের উপযোগী করছেন। বর্তমানে নদীর পানির লবণাক্ততা খুবই কম। ওই লবণাক্ত পানি দিয়ে চাষাবাদ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।
গত রোববার দুপুরের দিকে ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরখালী ইউনিয়নের শিবনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘ্যাংরাইল নদের শিবনগর বাজারের পাশের স্লুইসগেট (জলকপাট) খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে নদীর জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে খালে। পূর্ব পাতিবুনিয়া ও শিবনগর গ্রামকে বিভক্ত করা ছোট খালটি লম্বা চলে গেছে পশ্চিম দিকে। ওই খালের দুই পাশেই রয়েছে কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার বিঘা জমি। কিন্তু এতে কোনো ফসল চাষ করা হয়নি। কিছু জায়গায় ধানের বীজতলা করা হয়েছে শুধু। খাল থেকে নদীর পানি চলে যাচ্ছে ওই জমিতে। অনেক কৃষক ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করতে লেগে গেছেন। আবার অনেকে বীজতলা থেকে ধানগাছের চারা তুলছেন চাষ করা জমিতে বপনের জন্য।
ঘুরুনিয়া গ্রামের বিলে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করছিলেন সুরঞ্জন মণ্ডল। তিনি বলেন, পানি না থাকায় ওই দিনই প্রথম স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হয়েছে। স্লুইসগেট সাধারণত ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি সরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। বৃষ্টি না হওয়ায় আমন মৌসুম শুরু হলেও কোনো কৃষক জমি চাষ শুরু করতে পারেননি। অন্য বছর এ সময়ে ধান লাগানো প্রায় শেষ হয়ে যায়। আর এ বছর কেউ এখনো ধান লাগানো শুরুই করতে পারেননি। সব মিলিয়ে এক মাসের মতো কৃষকেরা পিছিয়ে রয়েছেন। এখন চাষাবাদ শুরু করতে না পারলে এ বছর আর ধান ঘরে তোলা যাবে না।
শিবনগর বিলে ১২ বিঘা জমি রয়েছে পূর্ব পাতিবুনিয়া গ্রামের পলাশ রায়ের। তিনি বলেন, আমন মৌসুম শুরু হলেও চাষাবাদ শুরু করতে না পারায় তাঁর মতো অনেকেই খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পরে এলাকার মানুষ নদীর পানি তুলে চাষাবাদ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন নদীর পানিতে যে লবণাক্ততা রয়েছে, তাতে চাষ চালিয়ে নেওয়া যাবে। তবে পরে বৃষ্টি না হলে বিপদ বাড়বে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৯৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছে। বীজতলা করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় আমন ধানের আবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। এ কারণে জেলা সমন্বয় কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনা করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের হাতে নেওয়া হয়েছে। নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এতে যে পরিমাণ লবণাক্ততা রয়েছে, তা দিয়ে কৃষিকাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। সে কারণেই আমন আবাদে নদীর পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার কিছু নদীর পানি এখনো বেশ লবণাক্ত। ওই সব এলাকার কৃষকেরা আমন চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।