মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করে ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠানো হতো

লিবিয়ার নির্যাতনের শিকার আল আমিনকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

পরিবারের অভাব দূর করার জন্য শরীয়তপুরের তিন তরুণ ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতালি নেওয়ার লোভ দেখিয়ে একটি দালালচক্র লিবিয়ায় তাঁদের জিম্মি করে। ৩৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ওই টাকা আদায় করতে লিবিয়ার সমুদ্রবর্তী একটি এলাকায় ১১ মাস তাঁদের বন্দী করে রাখা হয়। দিনে দুবার নির্যাতন করে সেই ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠানো হতো। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় দেশে ফেরা তিন তরুণ এভাবেই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন।

এই তিন তরুণ হলেন শরীয়তপুর সদর উপজেলার উত্তর ভাসানচর গ্রামের খলিল ফকিরের ছেলে আল আমিন ফকির (২০), এনামুল হক মাতবরের ছেলে ফেরদৌস মাতবর (১৯) ও নড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ নড়িয়া এলাকার বাদশা খানের ছেলে রাকিব খান (১৯)। অসুস্থ অবস্থায় গ্রামে ফিরে তাঁরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মুক্ত করতে গিয়ে পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে।

আল আমিন ফকিরের মা মঞ্জিলা বেগম বলেন, ‘ছেলেদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে ঘরবাড়ি সব হারিয়েছি। আমরা নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছি।’

শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, উত্তর ভাসানচর গ্রামের হাবীবুল ব্যাপারী বিদেশে লোক পাঠান—এমন খবর পেয়ে তিন তরুণের পরিবার যোগাযোগ করে। প্রথমে লিবিয়া, পরে সেখান থেকে ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি হয় হাবীবুলের সঙ্গে। দুই দফায় তিন তরুণের পরিবার হাবীবুলকে ১১ লাখ টাকা করে দেয়।

বর্তমানে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন তরুণের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বন্দী থাকার সময়কার নির্যাতনের কথা বলেন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে থাকা নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখান।

পরিবারের সদস্যদের ভিডিও কলে রেখে আমাদের মারধর করত। বাধ্য হয়ে পরিবার টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আমিন, নির্যাতনের শিকার

আমিন, ফেরদৌস ও রাকিবের ভাষ্য, গত বছরের ২৬ মার্চ তাঁরা লিবিয়া যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। লিবিয়ায় মকিবুল ওরফে মকবুল ও মুকুল নামে দুজন তাঁদের নিয়ে জোয়ারা এলাকায় তিন মাস আটকে রাখেন। এরপর তাঁদের ত্রিপোলি শহরের তারিক মাতার এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতে দেওয়া হয়। তিন মাস কাজ করার পর সমুদ্রের তীরবর্তী সাবরোতা শহরে নেওয়া হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সমুদ্রপথে ইতালি পাঠানোর জন্য। সেখানে বেশ কিছু দিন আটকে রাখা হয়। এরপর ওই দুই ব্যক্তি ২০২২ সালের ১ নভেম্বর তাঁদের তুহিন নামের একজনের কাছে তুলে দেন। তুহিন তাঁদের জাওইয়া নামের একটি স্থানে আটকে রাখেন। সেখানে আটকে রেখে তিন তরুণের মুক্তির জন্য ১১ লাখ টাকা করে পরিবারের কাছে দাবি জানানো হয়।

মুক্তিপণ আদায় করার জন্য তরুণদের দিনে দুই দফা করে মারধর করা হতো। মারধরের ওই দৃশ্য ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের দেখানো হতো। তুহিনের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের শংকরদি গ্রামে। তুহিনের দাবি করা টাকা নিতে এসে গত বছরের নভেম্বরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মনিরা বেগম নামের এক নারী। আদালতের মাধ্যমে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিন মাস পর তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে এসে পলাতক।

তিন তরুণের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্তানদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে আমিনের পরিবার ১০ শতাংশ জমিসহ বসতবাড়ি বিক্রি করে দেয়। ফেরদৌসের পরিবার কৃষিজমি বন্ধক রেখে, গরু-ছাগল বিক্রি করে এবং ঋণ করে টাকা সংগ্রহ করে। আর রাকিবের পরিবার অটোরিকশা, গরু-ছাগল বিক্রি এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা জোগাড় করে তুহিনের পাঠানো লোকের কাছে তুলে দেয়। টাকা পাওয়ার পরও তুহিন ওই তরুণদের না ছেড়ে আরও টাকার জন্য নির্যাতন শুরু করেন।

দিনে একবার রুটি খেতে দিত। ১১ মাস মারধরের ব্যথায় কেঁদেছি, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করেছি।
রাকিব, নির্যাতনের শিকার

আমিনের মা মঞ্জিলা বেগম বাদী হয়ে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা করেন সদরের পালং মডেল থানায়। ওই মামলায় হাবীবুল ব্যাপারী, মকবুল হোসেন ও ছলেমান ব্যাপারীকে আসামি করা হয়। পুলিশ তখন ওই তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন।

তিন তরুণ জানান, তাঁদের ১১ মাস আটকে রাখার পর গত ৩ অক্টোবর স্থানীয় একটি পুলিশ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ তাঁদের ত্রিপোলি শহরের আন্দারা কারাগারে পাঠায়। সেখান থেকে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাঁদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন। গত ৩০ নভেম্বর ওই তিন তরুণ গ্রামে ফিরে আসেন।

আমিন বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের ভিডিও কলে রেখে আমাদের মারধর করত। বাধ্য হয়ে পরিবার টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আরও টাকা পাওয়ার আশায় আবার নির্যাতন করতে থাকে। ১১ মাস পর স্থানীয় একটি বাহিনী আমাদের উদ্ধার করে পুলিশে দেয়।’

রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে একবার রুটি খেতে দিত। ১১ মাস মারধরের ব্যথায় কেঁদেছি, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করেছি।’

ছেলেদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে ঘরবাড়ি সব হারিয়েছি। আমরা নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছি।
মঞ্জিলা বেগম, নির্যাতনের শিকার আমিনের মা

নির্যাতনের কথা মনে করে ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের হাত-পা বেঁধে মারধর করা হতো। লাঠি ভেঙে গেলে আবার নতুন লাঠি দিয়ে পেটাত। ১১ মাস মার খেতে খেতে শরীরে ঘা হয়ে গেছে। পুলিশ উদ্ধার করার পর কিছু ওষুধ পেয়েছি। এখনো শরীর দুর্বল, সারা শরীরে ব্যথা। ঠিকমতো হাঁটতে পারি না।’

গতকাল সোমবার সকালে ভাসানচর গ্রামে গিয়ে হাবীবুলকে পাওয়া যায়নি। এ কারণে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের শিকার তিন তরুণ অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে। তাঁদের জবানবন্দি আদালতের মাধ্যমে নেওয়া হবে। ওই দালালচক্রের সঙ্গে আর কারা জড়িত, তাদের সন্ধান করা হচ্ছে।