যেখানে জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি

কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে পণ্য পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কয়েক শ গাড়িয়াল
ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রামের চার শতাধিক চরকে ঘিরে রেখেছে তিস্তা, ধরলা, গঙ্গাধর ও ব্রহ্মপুত্র নদ। বর্ষা মৌসুমে এসব চরাঞ্চল পানিতে থই থই করে। আর শুকনা মৌসুমে রূপ নেয় ধু ধু মরুভূমিতে। তখন চরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের একমাত্র বাহন হয়ে ওঠে ঘোড়ার গাড়ি। এ মৌসুমে চরাঞ্চলের কয়েক শ মানুষের জীবিকার মাধ্যম এ বাহন। ধু ধু বালুচর দিয়ে ছুটে চলা এসব গাড়িকে দেখে মনে হয় যেন ঘোড়ার জাহাজ।

চিলমারী উপজেলার করাইবরিশাল, নয়ারহাট, শাখাহাতি, অষ্টমীরচর, আমতলী; উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, জাহাজের আলগা; সদর উপজেলার রলাকাটার চর, যাত্রাপুর, পোড়ারচরসহ নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর, নুনখাওয়া ইউনিয়নের কয়েকটি দুর্গম চরে এভাবে ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক শ মানুষ।

এসব এলাকার ঘোড়ার গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত মাইক্রোবাসের পুরোনো চাকা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করেন তাঁরা। একটি গাড়িতে দুটি চাকা থাকে। প্রতিটি গাড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। গাড়ি টানার ঘোড়া কিনতে লাগে আরও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে আয় হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ঘোড়ার খাবার কিনে যা থাকে, সেটা দিয়ে চলে সংসার।

সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটের ঘোড়ার গাড়ি তৈরির কারিগর ইব্রাহীম প্রথম আলোকে বলেন, মাইক্রোবাসের পুরোনো চাকা ও রড দিয়ে ঘোড়ার গাড়ির ফ্রেম তৈরি করা হয়। গাড়ির ওপরে পণ্য পরিবহনের জন্য দেওয়া হয় বাঁশের ছাউনি। বালুচর ও অসমতল সড়কে অনায়াসে ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করা যায় বলে এর চাহিদা বাড়ছে।

চিলমারী জোড়গাছ ঘাটের গাড়িয়াল কিশোর রাকিব (১২) জানায়, সে স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। সপ্তাহে দুই দিন (রোববার ও বুধবার) জোড়গাছ হাট। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এ হাটে আসে। ওই দিন পণ্য পরিবহনের চাপ বেশি থাকে। হাটের দিন সে বাবার সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি চালায়। তার বাবা অসুস্থ থাকায় এদিন একাই গাড়ি নিয়ে আসে রাকিব।

সদর উপজেলার যাত্রাপুর হাটে নাগেশ্বরী, সদর, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার অর্ধশতাধিক চরের মানুষ বেচাকেনা করতে আসেন। নৌকাঘাট থেকে বাজারে আসতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় এক কিলোমিটার। এসব চরাঞ্চলের মানুষ নিজেরা পায়ে হেঁটে যাত্রাপুর বাজারে এলেও পণ্য পরিবহন করতে হয় ঘোড়ার গাড়িতে।

শুষ্ক মৌসুমে বালুতে গাড়ি চালাতে পরিশ্রম বেশি হয় বলে জানিয়েছেন যাত্রাপুর ঘাটের ঘোড়ার গাড়িচালক মমিনুল ইসলাম (৩৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন পুরুষ ধরে তাঁরা যাত্রাপুর ঘাট এলাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালান। যাত্রাপুরে সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার হাট বসে। এ হাটে অর্ধশতাধিক চর থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। যাত্রাপুর বাজার থেকে নৌকাঘাট পর্যন্ত প্রতি মণ মালামাল পরিবহনে ২০ টাকা করে নেওয়া হয়। একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০ মণ মালামাল পরিবহন করা যায়। একেকটি হাটে সারা দিনে তাঁর আয় হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যান্য দিনে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়।

৫ নম্বর চিলমারী ইউনিয়নের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী আঙ্গুর মিয়া বলেন, বর্তমানে শ্রমিক দিয়ে পণ্য স্থানান্তর করা ব্যয়বহুল। এ ছাড়া শ্রমিক পাওয়া যায় না। বর্ষা মৌসুমে চরাঞ্চলগুলো পানিতে তলিয়ে গেলে যাতায়াতের মাধ্যম হয় নৌকা। তবে শুষ্ক মৌসুমে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ঘোড়ার গাড়ি। আর এভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন চিলমারী ইউনিয়নের চরাঞ্চলের দুই শতাধিক গাড়িয়াল।

চিলমারী ইউনিয়ন নৌকাঘাট থেকে করাইবরিশাল বাজার এলাকার দূরত্ব এক কিলোমিটার। এটুকু পথে ঘোড়ার গাড়িতে পণ্য পরিবহন করতে মণপ্রতি ১০ টাকা নেন গাড়িয়ালেরা। এ ছাড়া ছোট ছোট মালামালের জন্য এক খেপে তাঁরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে নেন।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, কুড়িগ্রামের অর্ধশতাধিক চরের মানুষ তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে যাত্রাপুর হাটে আসেন। শুকনা মৌসুমে হাট থেকে একটু দূরে নৌকা নোঙর করে রাখতে হয়। সেখান থেকে যাত্রাপুর হাট পর্যন্ত মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি।