হুইসেল বাজিয়ে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের দিকে ছুটে আসছে ট্রেন। অপর পাশ থেকে একটি ভাঙাচোরা চা–দোকান থেকে বাঁশি বাজিয়ে ও হাতে সবুজ পতাকা নিয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে ছুটে আসলেন এক ব্যক্তি। দৌড়ে গেলেন বাঁশের তৈরি প্রতিবন্ধক ফেলতে। কেউ কেউ প্রতিবন্ধক উঠিয়ে রাস্তা পার হতে চাইলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের থামিয়ে দিলেন। পতাকা নেড়ে ট্রেনটিকে সবুজসংকেত দিতে থাকেন। ট্রেন যাওয়ার পরপরই রাস্তা ছেড়ে দেন তিনি।
জামালপুর পৌর শহরের বনপাড়ার রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে দেখা মেলে এই দৃশ্যের। প্রতিদিন এভাবেই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংটি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালনকারী এই গেটকিপারের নাম মো. নাজিম উদ্দিন (৪৫)। তবে তিনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি নন। তিনি নিজ উদ্যোগে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পেশায় তিনি একজন দরিদ্র চা-দোকানি। রোদ-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন তিনি। ট্রেন আসার সময়ে কখনো তিনি উপস্থিত না থাকলে, এই কাজটি তাঁর স্ত্রী বা সন্তানেরা করে থাকেন। এক বছর ধরে তিনি নিজ উদ্যোগে এই কাজটি করে যাচ্ছে।
তবে এই কাজে তাঁকে উৎসাহ এবং বাঁশি, সবুজসংকেত দেওয়ার পতাকা, লেভেল ক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধক তৈরির সরঞ্জাম ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন মো. ইউসুফ আলী নামের একজন পুলিশ সদস্য। ইউসুফ আলীর বাড়ি শেরপুরের চকসাহাব্দী এলাকায়। তিনি ঢাকা গুলশান থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হিসেবে দায়িত্ব রয়েছেন। তিনি নাজিম উদ্দিনকে প্রতি মাসে আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করে থাকেন।
ইউসুফ আলী বলেন, ‘জামালপুরে একসময় জেলা প্রশাসকের দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সেই সময় একটি অরক্ষিত রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ে চোখের সামনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার দৃশ্যটি দেখার পর থেকে আমার মাথায় চিন্তা আসে। জামালপুরের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপদে গাড়ি পারাপারের দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা আসে। কিন্তু আমার তো সেই সামর্থ্য নেই। ছোট্ট চাকরির টাকায় বাবা-মা ও পরিবার চালাতে হয়। তাই সেই সময় এই কাজটি করতে পারিনি। সামর্থ্য না থাকলেও মনের প্রবল ইচ্ছায় স্বপ্ন দেখা থেমে যায়নি। একদিন সেখানে যাই, কাউকে অল্প টাকায় পাওয়া যায় কি না? নিরাপদে গাড়ি পারাপারের দায়িত্ব পালনের জন্য। সেখানেই দেখা হয় নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে। পরে সঠিকভাবে লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে প্রস্তাব দিই। তিনি রাজি হন। তাঁকে আমার বেতনের একটি অংশ থেকে প্রতি মাসে কিছু আর্থিক সম্মানী দিই।’
নাজিম বলেন, ‘বছরখানেক আগে চোখের সামনে, একটি সরকারি গাড়িকে ট্রেন ধাক্কা দিল। গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে গেল। সেই দিনই ঠিক করি, চা-দোকানের পাশাপাশি এই লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপদে যানবাহন পারাপার করব। হঠাৎ একদিন ইউসুফ আলী নামের একজন পুলিশ সদস্য আসেন। তিনিও এই লেভেল ক্রসিংয়ে আমাকে দায়িত্ব পালনের জন্য উৎসাহ দেন এবং আমার টানাটানির সংসারের কথা শুনে এই লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালন করলে, তিনি মাসে মাসে কিছু টাকা আর্থিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমিও রাজি হই। তারপর ওই পুলিশ সদস্য তাঁর টাকায় বাঁশি, সবুজ পতাকা ও দুই পাশে বাঁশের গেট তৈরির খরচ দেন।’