মা–বাবাহারা সেই রায়হান এসএসসিতে পেয়েছে জিপিএ–৪.১৮

রায়হান আলী ও তার বোন আরিফা খাতুন
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মা–বাবাহারা রায়হান আলী এবার এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে সে জিপিএ–৪.১৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যের কাজ করে অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে এমন ফল করে বেশ খুশি রায়হান।

উপজেলার হাটগাঙ্গোপাড়া টেকনিক্যাল হাইস্কুলের ড্রেস মেকিং ট্রেড থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল রায়হান আলী। গতকাল শুক্রবার সকালে মুঠোফোনের মাধ্যমে নিজের ফল সংগ্রহ করেছে সে। ছোট বোন আরিফা খাতুনকে নিজের পরীক্ষায় ফল জানায়। পরে দুই ভাইবোন আনন্দে কেঁদেছে।

২০২০ সালের ৬ জুন প্রথম আলোর অনলাইনে ‘অনাথ ভাইবোনের ঈদের খাবার ডাল-ভাত’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে অনেকে দুই ভাইবোনকে সহায়তা করেন। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্তমানে পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শরিফ আহম্মেদ পাশে দাঁড়ান। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয় অনাথ দুই ভাইবোনকে।

বাগমারা উপজেলার বুজরুককোলা গ্রামের মৃত আবদুল আলীর সন্তান রায়হান আলী ও আরিফা খাতুন। ১০ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা রেহেনা বেগমের আশ্রয়ে ছিল দুই ভাইবোন। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারতেন না রেহেনা। এখান-ওখান থেকে কিছু সংগ্রহ করে সন্তানদের দেখাশোনা করছিলেন। বাবার অভাব খুব একটা বুঝতে দেননি সন্তানদের। তিন বছর আগে তিনিও মারা যান। সেই থেকে একেবারে এতিম হয়ে যায় রায়হান হোসেন ও তার আরিফা খাতুন। জীবনসংগ্রামে নামতে হয় দুই ভাইবোনকে।

বাবার রেখে যাওয়া আধভাঙা ভ্যানের প্যাডেল কিছুদিন ঘুরালেও তা বেশি দিন পারেনি রায়হান। পরে পেশা পরিবর্তন করে অন্যের পানবরজে কাজ নেয়। শত কষ্টের মধ্যেও লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন দুই ভাইবোনের। আরিফা খাতুন উপজেলার মচমইল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির ছাত্রী।

রায়হান আলী
ছবি: সংগৃহীত

রায়হান আলী জানায়, চেষ্টা করলে আরও ভালো ফল করা যেত, তবে এটাতেই খুশি। অন্যের ও নিজের সংসারের কাজ করে এমন ফল মন্দ নয়। রায়হান বলে, ‘বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল আমরা (ভাইবোন) লেখাপড়া করে চাকরি করব। তাঁদের ইচ্ছে পূরণে দুই ভাইবোন লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। তবে পরীক্ষায় পাস করেও খুশির সংবাদটি মা-বাবাকে জানাতে পারিনি। তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়তো খুশি হতো। ফল নিয়ে ঘরে বসে ভাইবোন বাবা-মায়ের কথা মনে করে কেঁদেছি।’

নিজের লেখাপড়া চালিয়ে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে রায়হান। সেই সঙ্গে তার বোন আরিফা যাতে লেখাপড়ে করে ভালো কিছু করতে পারে, সে চেষ্টাও অব্যাহত রাখার কথায় জানায় সে। রায়হান বলে, ‘পরীক্ষার আগে শিক্ষা বোর্ড, স্কুলের বেতনসহ অন্যান্য ফি বাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নিরুপায় হয়ে ইউএনও স্যারকে বিষয়টি জানাই। তিনি দেখা করতে বলেছিলেন। পরের দিন তাঁর দপ্তরে গিয়ে দেখা করলে তিনি আড়াই হাজার টাকা দেন। ওই টাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি। ইউএনও স্যার টাকা না দিলে হয়তো পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব হতো না।’

ভাইয়ের এমন ফলে বোন আরিফাও খুশি। সে জানায়, দুই ভাইবোন মিলে সংসার সামলানোর পাশাপাশি তারা লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।

হাটগাঙ্গোপাড়া কারিগরি হাইস্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট আসাদুল ইসলাম বলেন, রায়হান আলী তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে। কাজের কারণে সে নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে পারত না।

বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এফ এম আবু সুফিয়ান বলেন, রায়হান আলী পরীক্ষার খরচের বিষয়টি জানালে তাকে সহযোগিতা করা হয়। জীবিকার সংগ্রামের পরও যে ফল করেছে, তা প্রশংসনীয়।