গরম তেলে ঝলসে দেওয়ার বিচারসহ হোটেলে বসে খাওয়ার অধিকার চান হরিজনেরা

সান্তাহারে হরিজন যুবক মিঠুন বাঁশফোরকে গরম তেলে ঝলসে দেওয়ার ঘটনায় বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলন। শনিবার দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাব মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার শহরে হরিজন সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে মারধরের পর কড়াইয়ের ফুটন্ত গরম তেলে ঝলসে দেওয়ার বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় খাবারের হোটেলগুলোয় হরিজনসহ দলিত সম্প্রদায়ের লোকজনের খাওয়ার ক্ষেত্রে যে অলিখিত ‘নিষেধাজ্ঞা’ রয়েছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

আজ শনিবার বগুড়া প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের (বিডিইআরএম) পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিডিইআরএমের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে মিঠুন বাঁশফোর (২৩) নামের একজনকে গরম তেলে ঝলসে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং হোটেলে বসে খাওয়ার অধিকারের দাবিতে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন ১১ ডিসেম্বর সান্তাহার শহরের এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন।

আজ সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, হরিজন যুবক মিঠুন বাঁশফোরকে কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলে দগ্ধ করা হলেও প্রভাব খাটিয়ে চিকিৎসার খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ ঘটনা মিটমাট করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম খান। বিডিইআরএম মনে করে, এ ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরও বাড়বে। এতে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

হোটেলের কর্মচারীকে স্পর্শ করায় ঝোল দিতে রাজি হননি। এ নিয়ে হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হোটেলের কর্মচারীরা মিঠুন বাঁশফোরকে লাঠি ও শাবল দিয়ে মারধরের পর ধাক্কা দিয়ে হোটেল থেকে বের করে দেন।

সংবাদ সম্মেলনে বিডিইআরএমের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিভূতোষ রায় বলেন, ১১ ডিসেম্বর বিকেলে সান্তাহার পৌর এলাকার এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা হরিজন সম্প্রদায়ের যুবক মিঠুন বাঁশফোরকে মারধরের পর ধাক্কা দিয়ে কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে ফেলে দেন। এতে তাঁর ডান হাত ঝলসে যায়। মিঠুন বাঁশফোরকে প্রথমে আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রভাবশালীদের চাপে পুরোপুরি সুস্থ না হতেই মিঠুন বাঁশফোর হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছেন।

বিডিইআরএম নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিঠুন বাঁশফোর রাজশাহী মহানগর হরিজনপল্লির মদন বাঁশফোরের ছেলে। তিনি ১০ ডিসেম্বর সান্তাহারে তাঁর আত্মীয় পিন্টু বাঁশফোরের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। পরদিন বিকেলে আত্মীয় পিন্টু বাঁশফোরসহ তিনজন সান্তাহার পৌর এলাকার এশিয়া হোটেলে খেতে যান। ওই হোটেলে হরিজন সম্প্রদায়সহ নিম্নবর্ণের লোকজনের জন্য প্লেট ও গ্লাস স্পর্শ এবং হোটেলে বসে খাবার খাওয়া ‘নিষিদ্ধ’। পরে হোটেলের নিয়ম মেনে তাঁরা প্যাকেট বিরিয়ানি কেনেন। হোটেলে বসে খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ায় তাঁরা বিরিয়ানির সঙ্গে মাংসের আলাদা ঝোল চান। কিন্তু হোটেলের কর্মচারীকে স্পর্শ করায় ঝোল দিতে রাজি হননি। এ নিয়ে হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হোটেলের কর্মচারীরা মিঠুন বাঁশফোরকে লাঠি ও শাবল দিয়ে মারধরের পর ধাক্কা দিয়ে হোটেল থেকে বের করে দেন। ধাক্কায় গরম কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের ওপর পড়ে যান। এতে তাঁর ডান হাতের কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত ঝলসে যায়। খবর পেয়ে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন হোটেল ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। হোটেল বন্ধ করে গা ঢাকা দেন মালিক ও কর্মচারীরা।

মিঠুন বাঁশফোরকে আদমদিঘী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়। গত ১১ ডিসেম্বর
ছবি: সংগৃহীত

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিডিইআরএমের পক্ষ থেকে ঘটনার সরেজমিন তদন্তে গিয়ে বেরিয়ে আসে, সান্তাহারে হোটেল–রেস্তোরাঁয় নিম্নবর্ণের লোকজনের খাবার ‘নিষিদ্ধ’। বাধ্য হয়ে দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন হোটেল থেকে প্যাকেটে করে খাবার কিনে বাইরে গিয়ে আহার সারেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নিয়ম, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের প্রতি এই বর্ণবাদী আচরণ রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। স্বাধীন রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার। এখানে দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়কে হোটেলে নিষিদ্ধ করে রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সান্তাহার এশিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা বলেন, ‘মারধর করা হয়নি। বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে মিঠুন বাঁশফোর নিজেই ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে পড়ে যান। কেউ তাঁকে ফেলে দেয়নি।’ হোটেলের অন্যতম অংশীদার গোলাম রব্বানী বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এখানকার সব হোটেলেই হরিজনদের হোটেলের বাইরে খাবার দেওয়া হয়। হরিজনদের সব হোটেলে বসে খাবার খাওয়ার রীতি চালু হলে আমাদের আপত্তি নেই।’ তিনি আরও বলেন, গরম তেলের কড়াইয়ে পড়ে আহত হরিজনের চিকিৎসা খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

আদমদীঘি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন হোটেল ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। কিন্তু তার আগেই হোটেল বন্ধ করে অভিযুক্ত ব্যক্তি গা ঢাকা দেন। পরে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন আমার অফিসে এলে আমি তাঁদের পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিই। কিন্তু তাঁরা মিঠুন বাঁশফোরকে গরম তেলে ঝলসানোর বিচারের বদলে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনকে হোটেলে নিষিদ্ধ করার নিয়ম প্রত্যাহার দাবি করেন। সান্তাহার ব্রিটিশ কলোনি ছিল। শত বছর ধরে সেখানে যে নিয়ম চালু আছে, তা এক দিনে বদলানো সম্ভব নয়। সময় লাগবে।’

জানতে চাইলে আদমদীঘি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম বলেন, ‘যত দূর জেনেছি, বিষয়টি হোটেলমালিকের সঙ্গে হরিজনদের মিটমাট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিডিইআরএম কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ, বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি রতন রবিদাস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বগুড়া জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসিদ নিগার খন্দকার, ব্লাস্ট বগুড়ার প্যানেল আইনজীবী হুমায়ূন কবির প্রমুখ।