যে স্কুলের ৪১ শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, শহীদ হন চারজন

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

তারুণ্যের উদ্দীপনাকে উজ্জীবিত রাখতে স্কুলে গঠন করা হয় ফুটবল দল। সেই দলই খেলার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেতে সংগঠিত হয় যোদ্ধা হিসেবে। পরে ওই স্কুলের মোট ৪১ শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন চারজন।

স্কুলটির নাম গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের গোসিংগা গ্রামে অবস্থিত। আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুলের শিক্ষকদের ভাষ্যমতে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সংখ্যা ও শহীদের সংখ্যার ভিত্তিতে এই স্কুলের পরিচিতি আছে দেশজুড়ে। এ ছাড়া ফুটবল দল গঠনের মধ্য দিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণার বিষয়টি স্থান পেয়েছে স্থানীয় লেখকদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশ কয়েকটি বইয়ে।

শ্রীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ফকিরের উদ্যোগে ১৯৭১ সালে গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় ফুটবল দল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬৮ সালে তিনি গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তখন ক্রীড়া শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। এই দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি তারুণ্যের উদ্দীপনাকে উজ্জীবিত রাখতে একটি ফুটবল দল গঠন করেন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার জন্য ফুটবলারদের সঙ্গে ওই স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একত্রিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তখন দাঁড়ায় ৪১ জনে।

শিক্ষার্থীদের ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নূর মোহাম্মদ ফকির। এ জন্য প্রথমে তিনি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগরতলায় কংগ্রেস ভবনে যান। সেখানে শরণার্থী হিসেবে নিজের নাম নিবন্ধন করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসেন। সেখান থেকে ফিরে এসে স্কুলের ফুটবল দল ও সাবেক শিক্ষার্থীদের দল থেকে কয়েক ধাপে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য আগরতলা নিয়ে যান। ১৯৭১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৯ ছাত্রকে নিয়ে তিনি আগরতলায় প্রশিক্ষণে যান। প্রথম ধাপে ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন আবদুল বাতেন, বাবর আলী সরদার, আবদুল আওয়ালসহ অন্যরা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ফকির
ছবি: প্রথম আলো

সেখান থেকে তাঁদের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাঁপানিয়া এলাকায় যমুনা নামের একটি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেই ক্যাম্পে চলে তাঁদের প্রশিক্ষণ। এরপর ক্রমান্বয়ে স্কুলের বাকি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে নিয়ে যান তিনি। ‌ প্রশিক্ষণ শেষে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম গ্রুপে ৫টি সেকশনে ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দেশে ফিরেন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ শেষে বাকিরাও দেশে ফিরে সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেন।

নূর মোহাম্মদ ফকির বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর শ্রীপুর উপজেলার ইজ্জতপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাহাব উদ্দিন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ের কুড়চাই গ্রামে শহীদ হন স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী আবদুর রাজ্জাক, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন ও কাপাসিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন স্কুলটির এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. সাজ্জাদ হোসেন।

গোসিংগা উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি স্কুল থেকে এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ আমাদের জন্য গর্বের। সারাদেশে আমাদের স্কুলের এই গৌরবের বিষয়টি আলোচিত। বর্তমান প্রজন্ম এই ইতিহাসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বুকে ধারণ করে।’

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শ্রীপুরের গোসিংগা ইউনিয়নের কাইচাবাড়ি, সাতখামাইর রেলস্টেশন, কাওরাইদের গোলাঘাট রেলসেতু, কাওরাইদ রেলস্টেশন, ইজ্জতপুর রেলসেতু, ও বলদি ঘাট উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় আটটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ। সশস্ত্র আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। একপর্যায়ে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে পিছু হটতে থাকে হানাদার বাহিনী। ওই রাতের মধ্যেই শ্রীপুর ছেড়ে পালায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। পরদিন ১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর হানাদার মুক্ত হয়।

শহীদ সাহাব উদ্দিনের বোন জামেলা খাতুন বলেন, ‘আমার একমাত্র ভাই (সাহাবুদ্দিন) ইজ্জতপুর যুদ্ধের আগের দিন বাড়িত আইছিন আমারে দেখতে। নিজের আতে রাইন্দা খাওয়াইছি ভাইয়েরে। জ্বর আছিন তার। বিদাই লইয়্যা যাওনের সময় মনডা জানি কিমুন কইরা উঠছিন আমার। কেডা জানতো এই যুদ্ধেই ভাই আমার মরবো! অহনো মনে অয় আবার বুঝি ভাই ফিরা আইবো বাড়িত।’