ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হলেন চা–বাগানের দিপসী ছত্রী

দিপসী রানী ছত্রী ইন্টারনেটের মাধ্যমেই নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পেরেছেন। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের নুনছড়া দ্বিতীয় খণ্ড চা-বাগানের বাসিন্দা তিনিছবি: প্রথম আলো

স্বামী অন্য নারীকে বিয়ে করেছেন, তাই সংসার টেকেনি দিপসী রানী ছত্রীর। বিবাহবিচ্ছেদের পর অভাব জেঁকে বসে জীবনে। পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। তখন পরিচিত একজনের পরামর্শে ইউটিউবে সেলাই শেখার বিভিন্ন ভিডিও দেখতে থাকেন। এরপর শুরু হয় চেষ্টা ও উদ্যোগ। ধীরে ধীরে দিপসী হয়ে ওঠেন সেলাইয়ে পারদর্শী। হয়েছেন স্বাবলম্বী। ঘুচেছে তাঁর অভাবও।

দিপসীর বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের নুনছড়া দ্বিতীয় খণ্ড চা-বাগানে। প্রায় ১৯ মাস আগে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এর চার মাস পর থেকেই তাঁর সেলাই শেখার চেষ্টা শুরু। এরপর কেনেন সেলাই মেশিন। এখন তিনি ব্যস্ত এক দরজি। কাঁথা, টেবিল ক্লথসহ নানা ধরনের পণ্য সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো সিলেটেও শেষ হয়েছে উঠান বৈঠক। এরই অংশ হিসেবে কানাইঘাট উপজেলার ২ নম্বর লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের নুনছড়া গ্রামের ভিপি সিংয়ের বাড়িতে আয়োজিত হয় উঠান বৈঠক। সেখানেই দেখা হয় দিপসীর সঙ্গে। জানা হয় ইন্টারনেট ব্যবহার করে দিপসীর স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প।

প্রায় দেড় বছর ধরে সেলাইয়ের কাজ করছেন দিপসী। নিজের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার মানুষজন তাঁর কাছ থেকে পোশাক সেলাইয়ের পাশাপাশি কাঁথা সেলাই করে নেন। এতে প্রতি মাসে গড়ে তাঁর আয় হয় ৮ হাজার টাকার মতো। অনলাইনেও ব্যবসার প্রচার শুরু করেছেন দিপসী। ফেসবুকে নিজের আইডিতে ব্যবসার পণ্য পোস্ট ও শেয়ার করেন। পাশাপাশি পরিচিত ও আত্মীয়স্বজনকে ব্যক্তিগতভাবে নিজের সেলাই করা বিভিন্ন পণ্যের ছবি পাঠাতেন। এসব কাজ দেখে অনেকেই তাঁকে সেলাইয়ের অর্ডার দেন। এভাবেই ক্রমে বাড়ছে দিপসীর কাজের ব্যস্ততা।

সিলেটের সাতটি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলাটির কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠক
ছবি: প্রথম আলো

দিপসী রানী ছত্রী জানান, সময় পেলেই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় হারিয়ে যান তিনি। বিশেষ করে ইউটিউবে সেলাইয়ের বিভিন্ন ভিডিও দেখার পাশাপাশি পছন্দের ভিডিওগুলো স্মার্টফোনে ডাউনলোড (সংরক্ষণ) করে রাখেন। অবসরে এসব ভিডিও দেখে কাঁথা সেলাইয়ের নকশা এবং সেলাইকাজ সম্পর্কে নিত্যনতুন ধারণা নেন। যেসব কাজ বুঝতে সমস্যা হয়, সেগুলো সম্পর্কে অনলাইনভিত্তিক সেলাই-প্রশিক্ষকদের কাছে ফেসবুক-ইউটিউবে যোগাযোগ করে জেনে নেন।

ইউটিউবে ‘নকশী সেলাই ঘর’ এবং ‘রকমারি সেলাই ঘর’ চ্যানেল থেকেই দিপসী বেশি কাজ শিখেছেন। তিনি নিয়মিত এসব চ্যানেল ফলো (অনুসরণ) করেন এবং যেকোনো প্রশ্ন থাকলে মন্তব্যে জিজ্ঞাসা করেন।

দিপসী বলেন, ‘কাজ শেখার পর প্রথম অবস্থায় বিক্রি খুব কম হতো। গ্রামে বাসায় বাসায় গিয়ে বিক্রি করা সম্ভব হতো না। তাই আমি ফেসবুকের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন কাজের ছবি আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতাম।’

দিপসী জানান, শুরুর দিন তিনি দুই গজ কাপড়ের একটি অর্ডার পান। পরে ধীরে ধীরে তাঁর দক্ষতা বাড়লে অনেকেই কাজের অর্ডার দিতে শুরু করেন। এখন গড়ে প্রতি মাসে ৬০ গজ থেকে ৭০ গজ কাপড়ের অর্ডার থাকে। প্রতিদিন ছয় থেকে আট ঘণ্টা সময় সেলাইয়ের কাজে ব্যয় করতে হয় তাঁর। ভবিষ্যতে দিপসী দরজির দোকান দিতে চান। যেখান থেকে তিনি নারীদের জামা, বোরকা, কাঁথাসহ বিভিন্ন কাপড় সেলাইয়ের কাজ করবেন।

এ ছাড়া নিজ গ্রামে তরুণী ও নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন দিপসী। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহার করে কীভাবে পণ্য বিক্রি করা যায়, সেটা এখন আমি ভালোভাবে রপ্ত করতে চাই। ভবিষ্যতে গ্রাম ও আশপাশের এলাকার বাইরে নিজের সেলাই করা কাঁথাসহ অন্যান্য পণ্য ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করব।’

ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজারের বেশি ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন
ছবি: গ্রামীণফোনের সৌজন্যে

দিপসীর মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীকে ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে ১৭ নভেম্বর থেকে সিলেটে শুরু হওয়া উঠান বৈঠক শেষ হয় ১১ ডিসেম্বর। এ জেলার সাতটি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ আয়োজন। গ্রামীণ নারীদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমটি। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি প্রান্তিক নারীদের সরাসরি শেখাতেই এ উদ্যোগ। আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া প্রচারাভিযানটির আওতায় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।