মৃত্যুও আলাদা করতে পারেনি চার বন্ধুকে

জুবায়ের আহসান, মেহেদী হাসান, আলী হোসেন ও নেহাল পাল
ছবি: সংগৃহীত

একসঙ্গেই চলাফেরা করতেন চারজন। বাড়িও পাশাপাশি গ্রামে। শুক্রবার রাতে প্রাইভেট কার নিয়ে জাফলংয়ের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালের পানিতে উল্টে যায় প্রাইভেট কারটি। সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একসঙ্গে চলাফেরা করা চার বন্ধুকে মৃত্যুও আলাদা করতে পারেনি। দুর্ঘটনাতে একই সঙ্গে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের জৈন্তাপুরের ৪ নম্বর বাংলাবাজার রাংপানি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের লামাপাড় গ্রামের জুবায়ের আহসান, পানিহারাহাটি গ্রামের মেহেদী হাসান, জাঙ্গালহাটি গ্রামের আলী হোসেন ও তোয়াসীহাটি গ্রামের নেহাল পাল। নিহত সবার বয়স ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।

জৈন্তাপুরের বাসিন্দা রাজু আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, চারজনই একঙ্গে চলাফেরা করতেন। তাঁরা ভালো বন্ধু ছিলেন। মৃত্যুও চার বন্ধুকে আলাদা করতে পারেনি। নিহত তরুণদের মধ্যে তিনজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁদের কোনো পদ ছিল না। তাঁদের মধ্যে নেহাল পাল সিলেট সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে এবং মেহেদী হাসান ও আলী হোসেন জৈন্তাপুর ডিগ্রি কলেজে পড়তেন। এ ছাড়া জুবায়ের আহসান প্রায় এক বছর আগে বিয়ে করায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না।

সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম বলেন, শিগগিরই জৈন্তাপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। নিহত তরুণদের মধ্যে নেহাল পালের নেতৃস্থানীয় পদে আসার কথা ছিল। অন্যদের মধ্যে মেহেদী ও আলী হোসেনেরও পদ পাওয়ার কথা ছিল। তবে এর আগেই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁরা না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

স্থানীয় লোকজন ও নিহত তরুণদের পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি জুবায়ের আহসান একটি প্রাইভেট কার কিনেছিলেন। সেটি নিয়েই তাঁরা শুক্রবার রাতে জৈন্তাপুর থেকে জাফলংয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের বাংলাবাজার এলাকায় পৌঁছালে প্রাইভেট কারটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খালে পড়ে উল্টে যায়। এ সময় প্রাইভেট কারের দরজা খুলে কেউ বের হতে পারেননি। প্রথমে স্থানীয় লোকজন প্রাইভেট কার থেকে তাঁদের উদ্ধার তৎপরতা চালান। পরে উদ্ধারকাজে যোগ দেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যরা। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।

আজ শনিবার বেলা দুইটার দিকে তিনজনের জানাজা জৈন্তাপুর উপজেলার রাজবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁদের পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। অন্যদিকে বিকেল চারটার দিকে বাড়ির পাশেই নেহাল পালের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

নিহত মেহেদী হাসানের চাচা আবদুল হামিদ বলেন, পরিবারের সদস্যরা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এমন ঘটনা তাঁরা কল্পনাও করেননি। চার বন্ধু একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। চারটি পরিবারেই মাতম চলছে।

জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, চারজনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পরে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হামলা, হবে মামলা

চার তরুণকে উদ্ধার করে জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে সেখানে তাঁদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় হাসপাতাল, স্টাফ কোয়ার্টারে ভাঙচুর করে স্থানীয় একদল লোক। এ সময় হাসপাতালে পার্ক করে রাখা সরকারি জিপে আগুন দেওয়া হয় ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়। তবে চিকিৎসায় কোনো অবহেলা করা হয়নি বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, হাসপাতালে চিকিৎসক ও অন্যরা তাৎক্ষণিক কোনো চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেটি দেননি। তাঁদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে হয়তো জীবন ফিরে পেতেন।

তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ওই সময় উপস্থিত ছিলেন। রাতে প্রথমে দুজনকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর আরও ১৫ মিনিট পর আরও দুজনকে হাসপাতালে আনার পরপরই জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় তাঁদের ইসিজিও করা হয়েছিল। পরে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় সিলেটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এ সময় হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সচালকের পদ শূন্য ছিল। এ জন্য দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে উত্তেজিত হয়ে প্রথম দফায় হাসপাতালের নিচতলা, স্টাফ কোয়ার্টারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।

মো. সালাহউদ্দিন মিয়া আরও বলেন, হামলা চলাকালে হাসপাতালে রক্ষিত একটি সরকারি জিপে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। দুটি গাড়ির প্রায় ৬০-৭০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতাল ও স্টাফ কোয়ার্টারের দরজা জানাল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বিস্তারিত উল্লেখ করে মামলা করা হচ্ছে।

জৈন্তাপুর থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, মামলা করা হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।