নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই চলছে বাল্কহেড

গত ৫ আগস্ট খালের লৌহজংয়ের রসকাঠি এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের একটি ট্রলার ডুবে নারী, শিশুসহ ১০ জন নিহত হন।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তালতলা-গৌরগঞ্জ খালে চলছে বাল্কহেড। গত সোমবার সকালে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও এলাকায়প্রথম আলো

দুর্ঘটনার শঙ্কায় মুন্সিগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল (পদ্মার শাখানদী) দিয়ে বাল্কহেড চলাচলের ওপর প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিনে-রাতে সমানতালে চলছে বাল্কহেড। এতে ওই খালের আবার দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ ছাড়া দুই পাড়ে ভাঙনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গত ৫ আগস্ট এই খালের লৌহজংয়ের রসকাঠি এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের একটি ট্রলার ডুবে নারী, শিশুসহ ১০ জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা সবাই সিরাজদিখান উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। এরপর খালে বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।

নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত রাখতে উপজেলা প্রশাসন, নৌ পুলিশ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) নির্দেশনা দেওয়া হয়। মাঝখানে কয়েক মাস বন্ধ থাকলেও নভেম্বরের শেষ দিক থেকে খালটি দিয়ে আবারও চলছে বাল্কহেড।

বেপরোয়াভাবে বাল্কহেড চলায় সেদিন দুই নাতি-নাতনিকে হারিয়েছি। বিচার এখনো পাইনি। প্রশাসন বলল, এ খালে বাল্কহেড চলবে না। এখন আবার চলছে। কেউ দেখছে না।
নুরুল ইসলাম, সিরাজদিখান এলাকার বাসিন্দা

গত সোমবার সকাল নয়টার দিকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই খাল দিয়ে সিরাজদিখান হয়ে খালি বাল্কহেড (আনলোড) আসছে। এভাবে ৩০ মিনিটে অন্তত ১৫টি বাল্কহেড পদ্মা নদীর দিকে যায়। এ সময় আল-আমিন নামে এক বাল্কহেডচালক বলেন, খালটি দিয়ে বাল্কহেড চলাচল করা যাবে না, সেটা তাঁরা জানতেন। তাহলে কীভাবে চলাচল করছেন, জানতে চাইলে আল–আমিন বলেন, বালিগাঁও এলাকার রাজন মুন্সী নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়েছে। ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে তিনি প্রতিদিন পদ্মা নদী থেকে বালু নিয়ে এ খাল দিয়ে যাতায়াত করেন।

বিষয়টি অস্বীকার করেছেন রাজন মুন্সী। তিনি বলেন, ‘খাল দিয়ে বাল্কহেড চলাচলের বিষয়ে কাউকে কোনো পারমিশন দিইনি। কারও কাছ থেকে কোনো টাকাও নিইনি। যিনি আমার কথা বলেছেন, তাঁকে বিষয়টি প্রমাণ করতে আসতে বলেছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনের চেয়ে রাতেই বেশি চলছে বাল্কহেড। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত রাজন মুন্সী, লৌহজংয়ের রিপন ঢালী, রিপন ওস্তাগার, ওসমান ওস্তাগার, রুবেল এবং বড়মোকাম এলাকার জাহিদ ও একই এলাকার এক নারী। তাঁদের সহযোগিতা করছেন বালিগাঁও এলাকার বালু ব্যবসায়ী সুজন মুন্সী। তবে সুজন মুন্সীর দাবি, তিনি চাঁদা নেওয়া এবং বাল্কহেডের বিষয়ে কিছুই জানেন না। লৌহজংয়ের রিপন ঢালী, রিপন ওস্তাগার, ওসমান ওস্তাগার, রুবেল এবং বড়মোকাম এলাকার জাহিদরা সব করছেন।

একটি নৌ দুর্ঘটনার পর তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল দিয়ে বাল্কহেড চলাচলে অস্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এখনো সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।
মো. জাকির হোসেন, লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

এ পথে আবার বাল্কহেড চলাচল শুরু হওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দা ও নৌ দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো ব্যক্তিরা। ৫ আগস্ট দুর্ঘটনায় দুই নাতি-নাতনি হারানো সিরাজদিখানের নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বেপরোয়াভাবে বাল্কহেড চলায় সেদিন দুই নাতি-নাতনিকে হারিয়েছি। এর বিচার এখনো পাইনি। প্রশাসন বলল, এ খালে বাল্কহেড চলবে না। এখন আবার চলছে। কেউ দেখছে না। আমরা যারা স্বজন হারিয়েছি, তারা তো এসব মেনে নিতে পারছি না।’

তালতলা-গৌরগঞ্জ খালে বাল্কহেড চলাচল বন্ধে নৌ পুলিশের তৎপরতা নেই বলে জানান স্থানীয় লোকজন। পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় এই খালে তৎপরতা চালাতে পারছে না বলে জানান মাওয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মূল পদ্মা থেকে বালু নিয়ে বাল্কহেডগুলো খালে প্রবেশ করে। আমরা নিয়মিত সেখানে তৎপরতা চালাচ্ছি যেন খালে বাল্কহেড ঢুকতে না পারে।’

পুলিশের ওই পরিদর্শক জানান, ট্রলার ডুবির ঘটনার পর থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত নৌ পুলিশের সহযোগিতায় ৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এতে ১৩ জন ড্রেজার মালিককে ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ১০ জন বাল্কহেড চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাল্কহেড দুর্ঘটনায় করা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন।

এদিকে বাল্কহেড চলাচলের কারণে সৃষ্ট ঢেউয়ে ভাঙছে খালপাড়ের জমি ও বসতভিটা। লৌহজংয়ের বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, ‘বাল্কহেডের ঢেউয়ে ২০২২ এ একবার বসতভিটা খালে বিলীন হয়েছে। সে সময় আমাদের মতো আরও ২০-২৫টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়। অন্যের জায়গায় ঘর করে আছি। এ বছর বর্ষায় বাল্কহেড বন্ধ ছিল। ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। মাসখানেক ধরে আবারও বাল্কহেড চলছে। শুকনো মৌসুমেও খালপাড় একটু একটু করে ভাঙছে।’

বিষয়টি নজরে আনা হলে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি নৌ দুর্ঘটনার পর তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল দিয়ে বাল্কহেড চলাচলে অস্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এখনো সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। বাল্কহেড চলাচল ও চাঁদা তোলার বিষয়টি শুনেছেন তিনি। এ কাজে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ইউএনও।