‘নির্বাচনী প্রচারণায় স্লোগান শুনলেই বুক ধড়ফড় করে’

২০২১ সালে নিহত আওয়ামী লীগের নেতা আজগর আলীসংগৃহীত

তিন বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরের পাঠানটুলি এলাকায় প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত হন মহল্লা সরদার আজগর আলী। আজগর নিজেও আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। তবে ওই ঘটনার বিচারপ্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি এখনো উদ্ধার করা হয়নি। পুলিশ শনাক্ত করতে পারেনি কে বা কারা গুলি করেছে।

সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। তবে প্রার্থী, সমর্থকদের স্লোগান কানে আসতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন আজগরের পরিবারের সদস্যরা। গতকাল শুক্রবার পাঠানটুলির মগপুকুরপাড় এলাকায় গেলে তাঁর ছেলে সেজান মাহমুদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় স্লোগান শুনলেই বুক ধড়ফড় করে। মনে হয়, কখন গুলির শব্দ পাই।’

সেজান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, স্লোগান শুনলেই তাঁর বাবাকে হারানোর কথা নতুন করে মনে পড়ে যায়। চোখে ভেসে ওঠে গুলিবিদ্ধ বাবার রক্তাক্ত লাশ। ঘটনার দিন প্রচারণার মিছিলের শেষের দিকে ছিলেন। এ কারণে প্রচারণার স্লোগান কানে বাজলে এখনো আঁতকে ওঠেন সেজান।

নিহত আজগর আলীর পরিবারের দাবি, মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের গোয়েন্দা শাখাও (ডিবি) বলতে পারছে না, কে বা কারা গুলি করেছিল আজগরকে। উদ্ধার করা হয়নি ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রও। তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় হতাশ তাঁরা।

আজগর আলীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা চলছিল মগপুকুরপাড় এলাকায়। ওই সময় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মী আজগর আলী।

কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া নজরুল শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর আবদুল কাদের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।

নজরুলের পক্ষ নেওয়ার কারণে আবদুল কাদেরের সঙ্গে আজগরের বিরোধ দেখা দেয়। সেই বিরোধ থেকে আজগর খুন হন বলে দাবি করছেন পরিবারের সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত আজগর আলীর ছেলে সেজান মাহমুদ বাদী হয়ে আবদুল কাদেরসহ ১৩ জনকে আসামি করে ডবলমুরিং থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে পুলিশ আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় কাদেরসহ ২০ জন গ্রেপ্তার হন। সবাই স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী। বর্তমানে সবাই জামিনে আছেন।

শুরু থেকে মামলাটি তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিন বছরে বদল হয়েছেন পাঁচ তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) মুহাম্মদ আলী হোসেন গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে কাজ চলছে। গুলিটি ভিড়ের মধ্য থেকে এসেছে, এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কে করেছে তা শনাক্ত করা যায়নি। তদন্ত শেষের দিকে। মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ছেলে সেজান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বিচার দূরে থাক, তদন্তই শেষ হয় কি না সন্দেহ।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের মগপুকুরপাড় এলাকাটি কাদেরের এলাকা হিসেবে পরিচিত। ঘটনার দিন রাতে সেখানে নজরুল তাঁর সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণায় যান। এ সময় গুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল ও আশপাশে সাতটি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেগুলো ভাঙা পাওয়া যায়। কয়েকটির ফুটেজ পাওয়া গেলেও তা ছিল অস্পষ্ট। গ্রেপ্তার আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ কিছুই বের করতে পারেনি।

জানতে চাইলে বর্তমানে জামিনে থাকা নগর যুবলীগের সদস্য আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে তাঁকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিনি নিজেও চান এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক, শনাক্ত হোক প্রকৃত আসামি।

তদন্তে কোনো কিনারা না হওয়ায় হতাশ নিহত ব্যক্তির স্ত্রী কামরুন নাহার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়। স্বামীর খুনের কোনো কিনারা হয় না। জড়িত আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন নতুন করে বাসার পাশের রাস্তা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার স্লোগান যখন কানে বাজে, বুকটা ফেটে যায়। এই কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না।’