সুরমা নদী ভরাটে সিটি করপোরেশন দায়িত্ব এড়াতে পারে না

সিলেট নগরে গত তিন মাসে অল্প বৃষ্টিতেই কয়েক দফা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাসাবাড়ি, দোকানপাট থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে পানি ওঠে। মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জলাবদ্ধতার কারণ ও সমাধানে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল হক শাকিলের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় পরিষদের সদস্য।

মোহাম্মদ জহিরুল হক

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সম্প্রতি অল্প বৃষ্টিতেই সিলেট নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এর কারণ কী?

মোহাম্মদ জহিরুল হক: অল্প বৃষ্টিতেই সিলেট নগরে জলাবদ্ধতার জন্য কিছু কারণ দায়ী। এগুলো হচ্ছে অপর্যাপ্ত ও অবৈজ্ঞানিক ড্রেনেজ–ব্যবস্থা, ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) দখল, বৃষ্টির পানির প্রাথমিক রিজার্ভার পুকুর-দিঘি ভরাট ও দখল, ড্রেনে ময়লা আবর্জনা, পলিথিন, জুতা-সেন্ডেল থেকে শুরু করে লেপ–তোশক ও পুরোনো কাপড়চোপড় ফেলে পানিপ্রবাহ বন্ধ এবং দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনগুলো সংস্কারের নামে ভেঙেচুরে ফেলে রাখা। এসব সমস্যা দূর হলে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার জন্য নগরবাসীকে নাকাল হতে হতো না।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন-প্লাস্টিক ফেলে ড্রেন ভরাটের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্য প্রায়ই নগরবাসীকে দোষারোপ করে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমরা সমস্যার দুষ্টু চক্রের মধ্যেই আবদ্ধ থাকব। সিটি করপোরেশনের কিছু কাজের একটি হচ্ছে ড্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। নগরবাসী যদি ড্রেনে ময়লা ফেলেন, সেটার বিরুদ্ধেও তারা ব্যবস্থা নিতে পারে। আর অনেক ড্রেন তো রাস্তার বালি ও মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। সেটার জন্য দায়ী কে? এমনকি নগরে অনেক ড্রেন রয়েছে পাশের রাস্তার  চেয়ে উঁচু। সেই ড্রেন কীভাবে পানি বহন করবে? পাঠানটুলা এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জমুখী রাস্তার পাশের ড্রেন এতটাই সরু যে একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন বলছে, সুরমা নদী খনন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

মোহাম্মদ জহিরুল হক: এ প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর নেই। এ বক্তব্য একদিকে সঠিক, আবার আরেক দিকে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো অবস্থা। সিটি করপোরেশনের এ বক্তব্য আমরা মানতে নারাজ। কারণ, গত জুন ও জুলাই মাসের জলাবদ্ধতা না হয় সুরমা নদীর তলদেশ ভরাটের জন্য হয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হয়ে মানুষের বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও অফিসে পানি ঢুকল, সে সময় তো সুরমা নদীতে পানি ছিল না বললেই চলে। তাহলে জলাবদ্ধতা হলো কেন? প্রকৃতপক্ষে, ড্রেন ও ছড়াগুলো এতটাই সরু করে ফেলা হয়েছে, যা পানি বহন করে সুরমায় পতিতের জন্য অপর্যাপ্ত।

আর সুরমা নদী ভরাটের পেছনে সিটি করপোরেশন তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সুরমার তলদেশ ভরাটের জন্য নগরের প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ও ময়লা আবর্জনা জমাট বাঁধাই দায়ী। ছড়া ও ড্রেনগুলোতে নেট না থাকায় এসব ময়লা-আবর্জনা সুরমায় চলে যাচ্ছে। তবে বর্ষাকালে সুরমা পানিতে টইটম্বুর থাকলে স্বাভাবিকভাবেই নগরের পানি ছড়া ও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে যেতে পারে না। কোনো কোনো সময় সুরমার পানি উপচে নগরে প্রবেশ করে। এ বছরের জুন ও জুলাই মাসের সংকটের জন্য সুরমা ভরাটকে দায়ী করা যেতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও কিছু স্থানে বক্স কালভার্ট নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতা তীব্র হচ্ছে। কী বলবেন?

মোহাম্মদ জহিরুল হক: আমি এ বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। সিলেট শহরের আশপাশের টিলাগুলোর পানি যখন তীব্রবেগে নেমে আসে তখন বক্সকালভার্ট সেই পানি প্রবাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পানি উপচে রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এসব বক্সকালভার্ট শুধু ছড়াকে সরু করছে না, দখলদারদেরও উসকে দিচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: জলাবদ্ধতা নিরসনের উপায় কী? এ সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব?

মোহাম্মদ জহিরুল হক: জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু উদ্য্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আধুনিক ড্রেনেজ–ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীদের আপডেটেড পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ড্রেনে ময়লা ফেলার বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশকে জিরো টলারেন্স হতে হবে। ছড়া, খাল ও ড্রেনের দখলকৃত জায়গা উদ্ধার করতে হবে। সুরমায় পতিত ড্রেন ও ছড়াগুলোতে নেটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বক্সকালভার্ট ভেঙে সেখানে ব্রিজ নির্মাণ ছাড়া জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ভরাট করা দিঘি ও পুকুর খনন করার পাশাপাশি বিদ্যমান পুকুর, দিঘি ও জলাশয় রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৃষ্টির পানি প্রথমেই সুরমায় চলে যায় না। প্রয়োজন পুকুর, দিঘি ও জলাশয়ের মতো প্রাথমিক রিজার্ভার। সিলেট নগরের প্রতিটি এলাকায় আগে এ ধরনের প্রাথমিক রিজার্ভার ছিল। এখন এসব প্রাথমিক রিজার্ভারের অভাবেই অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। অন্তত সুরমা নদীর সিটি করপোরেশন অংশ অবিলম্বে খনন করা প্রয়োজন। সেটা দ্রুত সম্ভব না হলে অন্তত সুরমার তলদেশ থেকে জমাট বাঁধা পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর অপসারণ করা প্রয়োজন।