মানিকগঞ্জে আতঙ্কে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা

  • সোনার গয়না তৈরির দোকানের পরিত্যক্ত ছাই, ধুলাবালু ও ময়লাযুক্ত মাটি কিনে আনেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

  • ছাইমাটি থেকে সোনা বের করা  ‘ছালি ব্যবসা’ বলে পরিচিত।

মানিকগঞ্জ জেলার মানচিত্র

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা ও আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেস স্বর্ণ ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে। গত এক বছরে সোনা ছিনতাইয়ের অন্তত ছয়টি ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে। সম্প্রতি র‌্যাবের এক সদস্যের নেতৃত্বে সোনা ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১৫০ বছর ধরে উপজেলার চারিগ্রাম ও গোবিন্দল গ্রামে ছাইমাটি থেকে সোনা বের করা শিল্প গড়ে উঠেছে। গ্রাম দুটিতে সহস্রাধিক পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস এ শিল্প। ছাইমাটি থেকে স্বর্ণ   বের করা স্থানীয়ভাবে ‘ছালি ব্যবসা’ বলে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সোনার গয়না তৈরির দোকানের পরিত্যক্ত ছাই, ধুলাবালু ও ময়লাযুক্ত মাটি কিনে আনেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব ছাইমাটি থেকে তাঁরা স্বর্ণ  সংগ্রহ করেন।

এসব সোনা বিক্রিতে স্থানীয়ভাবে বাজারও গড়ে উঠেছে। চারিগ্রাম এলাকায় চারিগ্রাম বাজার জুয়েলারি মার্কেট ও গোবিন্দল এলাকায় বেশ কয়েকটি জুয়েলারি দোকান গড়ে উঠেছে। এ দুটি মার্কেটে ১০০টির মতো সোনার অলংকারের দোকান বা জুয়েলারি রয়েছে। এ দুটি মার্কেট ছাড়াও ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় সোনা বিক্রি করে আসছেন ছাই ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এসব স্বর্ণ ব্যবসায়ী তাঁদের সোনা পরিবহনের সময় ঘটে থাকে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা।

অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে।

সোনা ছিনতাই-ডাকাতি ঘটছেই

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২ ডিসেম্বর পুলিশ পরিচয়ে সিঙ্গাইরের বাঘুলি এলাকা থেকে অপহরণের পর উজ্জ্বল সাহা (৩৬) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮৫ ভরি সোনা ও ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তিনি বাঘুলি গ্রামের নারায়ণ সাহার ছেলে। টাঙ্গাইলের করটিয়ায় তাঁকে রেখে পালিয়ে যায় অপহরণকারীরা।

এর আগে গত বছরের ৩০ এপ্রিল সিঙ্গাইরের সায়েস্তা ইউনিয়নের চঙ্গপুরা এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কৃষ্ণ সাহা (৫৫) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করা হয়। তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জ আগলার টিকিটপুর এলাকার বিজয় সাহার ছেলে। নবাবগঞ্জ থেকে পুলিশ পরিচয়ে ওই ব্যবসায়ীকে প্রাইভেট কারে তুলে ১৫০ ভরি সোনা ও আড়াই লাখ টাকা লুট করে চঙ্গপুরা এলাকায় ফেলে যায় অপহরণকারীরা।

সর্বশেষ গত শনিবার সকালে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে সিঙ্গাইরের জামশা ইউনিয়নের আমতলা এলাকা থেকে সুমন হালদার (৩৮) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে তাঁর কাছ থেকে ৯৫ ভরি স্বর্ণালংকার ও সোনার পাত লুট করে নিয়ে যায় ডাকাত সদস্যরা। পরে জামশা বাজারে তিনজন এবং পাশের গোলাইডাঙ্গা বাজার থেকে অপর এক ডাকাত সদস্যকে আটক করে গণপিটুনি দেন স্থানীয় লোকজন। পরে তাঁদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলেও লুট হওয়া সোনা উদ্ধার হয়নি। দুটি মোটরসাইকেল করে ডাকাত সদস্যরা এসব সোনা লুট করে নিয়ে যায়।

এ ছাড়া গত বছরের ১৩ অক্টোবর দৌলতপুর উপজেলা সদরে গুলি ছুড়ে ও ককটেল ফাটিয়ে ডাকাতেরা দিলীপ রাজবংশী নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

ব্যবসায়ীরা যা বলেন

গত রোববার দুপুরে চারিগ্রাম জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ হোসাইন দেওয়ানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত চার মাসে দোহার-জামশা-চারিগ্রাম সড়কে সোনা ডাকাতির চারটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন।

স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সংবাদদাতা (সোর্স) হিসেবে কাজ করছেন বলে তাঁর ধারণা। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কে, কখন ও কোথায় সোনা নিয়ে যাচ্ছেন, তা সংবাদদাতারা ডাকাত বা ছিনতাইকারীদের তথ্য দেন। সংবাদদাতাদের শনাক্ত ও লুট হওয়ায় সোনা উদ্ধারে প্রশাসনের প্রতি দাবি জানান। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় পুলিশের টহল জোরদার করারও দাবি জানান।

সরেজমিনে একদিন

শনিবার ওই দুটি গ্রামের অনেক বাড়িতে ছাইমাটি থেকে সোনা বের করার কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। এসব বাড়ির নারী ও পুরুষেরা এ কাজ করছেন। এসব সোনা বিক্রির জন্য স্থানীয় চারিগ্রাম বাজারে বিশাল জুয়েলারি মার্কেট গড়ে উঠেছে। ।

পুলিশের ভাষ্য

শনিবার সোনা ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগী স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুমন হালদার বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও দু–তিনজনকে আসামি করে সিঙ্গাইর থানায় মামলা করেছেন।

সিঙ্গাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জিয়াউল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি সম্রাট মৃধা, মিরাজুল শেখ, আমিজ উদ্দিন ও মোহাম্মদ শামীমুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে শামীমুজ্জামান সেনাসদস্য। তিনি র‌্যাব-১–এ কর্মরত ছিলেন। সেনাসদস্য হওয়ায় আসামি শামীমুজ্জামানকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা বর্তমানে কারাগারে।

মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা কেউ যদি চান তাঁরা বেশি পরিমাণে সোনা বিক্রি করতে অন্যত্র নিয়ে যাবেন, তখন পুলিশ সদস্যরা তাঁদের সহযোগিতা করতে পারেন; কিন্তু তাঁরা পুলিশকে জানান না। তবে পরিমাণে কম হলে তাঁরা নিজেরা বহন করতে পারেন। তাঁদের নিরাপত্তায় পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে।