নিজের স্কুলে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেও সাফল্য মোশাররফের

মোশাররফ হোসেনছবি: সংগৃহীত

বাড়িতে একটি টিনের ঘর। ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে সেই ঘরে থাকেন স্বামী-স্ত্রী। পাশে মাটির বেড়ার ভাঙাচোরা অপর ঘরটিতে একপাশে থাকে গরু; অন্যপাশে বড় দুই ছেলে। বসতবাড়িটা ছাড়া তাঁদের আর তেমন কোনো জমিজিরাত নেই। স্বামী আজিজুল ইসলাম অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। আর নাজমা আক্তার টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করেন।

কিন্তু এটুকুতে সংসার চলে না। অভাব–অনটন লেগেই থাকে। মা–বাবাকে সাহায্য করতে বড় ছেলে মোশাররফ হোসেন কৃষিকাজ করে। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজেও কম যায় না সে।

নাজমা আক্তার ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেন অন্য এক কারণে। তাঁর ছেলে পড়াশোনায় ভালো। খেতখামারে খাটাখাটুনি, দিনমজুরি করেও মোশাররফ এবার এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে। সে যেন নাজমার ভাঙা ঘরে একফালি চাঁদের আলো।    

মোশাররফ হোসেনের বাড়ি। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার রয়্যালবাড়ি ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

সারা দেশে প্রতিবছর এমন কত শত মোশাররফ দিনমজুরি খেটে পরীক্ষায় ভালো ফল করে। শত বাধা পেরিয়ে সাফল্য ছিনিয়ে আনে। আমরা তাদের নাম দিই অদম্য মেধাবী। মোশাররফের গল্পটা অন্য জায়গায়। সে যে বিদ্যালয়ে পড়ত, সেই বিদ্যালয়েই রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেছে। পারিশ্রমিকও পেয়েছে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে কথা কেউ টের পায়নি। মুখে কাপড় বেঁধে, কখনো মাস্ক পরে কাজ করেছে সে।

মোশাররফ হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ার রয়্যালবাড়ি ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে তার স্কুল কুতুবপুর গ্রামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নিজের গড়া বিদ্যালয়। সেই বিদ্যালয়ের ছাত্র মোশাররফ। বিদ্যালয়টিতে চারতলা একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। গত বছর পবিত্র রমজানের ছুটিতে ১৫ থেকে ২০ দিন নির্মাণাধীন সেই ভবনে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেছে মোশাররফ।

সে (মোশাররফ) যে মাঝেমধ্যে দিনমজুরি করে সংসারে সাহায্য করত, সেটা জানতাম। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়ে এসে কাজ করেছে, এটা আজই জানলাম। আগে জানলে ওকে কাজ করতে দিতাম না। অন্যভাবে সাহায্য করতাম।
—আসাদুজ্জামান, শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক।

হুমায়ূন আহমেদের গড়া বিদ্যালয়ের এক ছাত্র সেই বিদ্যালয়েই জোগালির কাজ করেছে—গত বৃহস্পতিবার এ কথা শুনে ছাত্র–শিক্ষক সবাই অবাক। প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বললেন, ‘সে (মোশাররফ) যে মাঝেমধ্যে দিনমজুরি করে সংসারে সাহায্য করত, সেটা জানতাম। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়ে এসে কাজ করেছে, এটা আজই জানলাম। আগে জানলে ওকে কাজ করতে দিতাম না। অন্যভাবে সাহায্য করতাম।’

গত ১২ মে এসএসসির ফল প্রকাশ হয়েছে। মোশাররফের বাবা–মা গত বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মিষ্টিমুখ করাতে গিয়েছিলেন। তখনই কথা প্রসঙ্গে বিদ্যালয় ভবনে মোশাররফের কাজের কথা তাঁরা জানতে পারেন, জানালেন প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান।

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলের সামনে সহপাঠী ও শিক্ষকের সঙ্গে মোশাররফ
ছবি: সংগৃহীত

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ থেকে এবার ৪৯ জন শিক্ষার্থীর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪৮ জনই জিপিএ–৫ পেয়েছে। মোশাররফ তাদেরই একজন। সে এবার মানবিক বিভাগ থেকে এই সাফল্য অর্জন করেছে। বিদ্যালয় থেকেও বিভিন্ন সময় তাকে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে। পরীক্ষার আগে বিদ্যালয় থেকে করানো বিশেষ কোচিংয়ের টাকা মোশাররফের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক

কথা হয় রয়্যালবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নূরে আলমের সঙ্গে। তাঁর বাড়িও হরিপুর গ্রামে।

মোশাররফকে তিনি ভালো করেই চেনেন। জানালেন, ওদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না।

ছেলেটা দিনমজুরি করে মা–বাবাকে সাহায্য করে। সে যে বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানেই রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করার কথা তিনিও শুনেছেন।

বৃহস্পতিবার রাতেই কথা হয় মোশাররফের সঙ্গে। সে তখন ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় এক চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। ভর্তি হতে এসেছো, জানতে চাইলে জবাবে বলল, ‘ইচ্ছা ছিল ময়মনসিংহে এসে পড়ার। এখন মনে হচ্ছে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে ভর্তি হতে হবে।’

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ থেকে এবার ৪৯ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪৮ জনই জিপিএ–৫ পেয়েছে। মোশাররফ তাদেরই একজন। সে এবার মানবিক বিভাগ থেকে এই সাফল্য অর্জন করেছে। বিদ্যালয় থেকেও বিভিন্ন সময় তাকে সাহায্য–সহযোগিতা করা হয়েছে। পরীক্ষার আগে বিদ্যালয় থেকে করানো বিশেষ কোচিংয়ের টাকা মোশাররফের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক।

মোশাররফ ঢাকায় এসেছে অন্য কারণে। খানিকটা আমতা আমতা করে বললো, ‘এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা লাগবে। সেই টাকার জোগাড় করতে ঢাকায় এসেছে। এখানে সহজেই রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ পাওয়া যায়। রোজ সাড়ে ৫০০ টাকা করে মজুরি মেলে। কোরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত এই কাজ করার ইচ্ছা আছে।’

নিজের বিদ্যালয়ে কাজ করার ঘটনা জানতে চাইলে বলল, গত বছর রোজার সময় বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেই ছুটিতে নতুন ভবনের রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ নেয় সে। বন্ধুরা যখন কোচিং করছে, মোশাররফ তখন হাতুড়ি-বাটাল, ইট-কাঠ আর পাথর নিয়ে কাজে ব্যস্ত। শুরুতে ৪০০ করে পেলেও শেষের কদিন সাড়ে ৪০০ টাকা করে মজুরি পেয়েছে।

ভবিষ্যতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন দেখে মেধাবী মোশাররফ। সেই স্বপ্ন পূরণে যত ঝড়ঝাপটাই আসুক না কেন, একে একে সব বাধা ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায় সে।