সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে হামলায় নিহত ছয় বাংলাদেশির মধ্যে একজন মাসুদ রানা। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর করপোরাল (এমটি) ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবার ও স্বজনদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।আট বছর বয়সী একমাত্র সন্তান আসমা উল হুসনাকে বুকে জড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমি এখন আমার মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দিব। সে (মাসুদ রানা) তো সবার কথা ভাবত, এখন ওর মেয়ের জন্য কে ভাববে? এখন আমি কার ফোনের জন্য অপেক্ষা করব।’
গতকাল শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত ড্রোন হামলা চালালে বাংলাদেশি ছয় শান্তিরক্ষী নিহত হন। আহত হন আটজন। তাঁরাও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী। সবাই আবেইর জন্য জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী নিরাপত্তা বাহিনীতে (ইউএনআইএসএফএ) কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
নিহত ব্যক্তিদের একজন নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউনিয়নের বোয়ালিপাড়ার মাসুদ রানা। তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের ২১ পদাতিক ব্রিগেড থেকে শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করেন। এক মাস ছয় দিন আগে সুদান মিশনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বোয়ালিপাড়া গ্রামের সাহার উদ্দিন ও মর্জিনা বেগম দম্পতির বড় ছেলে। তাঁর অন্য দুই ভাই মনিরুল আলম ও রনি আলমও সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন।
রোববার বিকেলে বোয়ালিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দলে দলে লোকজন সাহার উদ্দিনের বাড়িতে জড়ো হয়েছেন। সেখানে কথা হয় মাসুদ রানার ছোট ভাই রনি আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা নিতান্তই একজন গরিব মানুষ ছিলেন। সামান্য যেটুকু জমি ছিল, তা বিক্রি করে মাসুদ ভাইকে মানুষ করেছিলেন। তিন বছর আগে আব্বাও মারা গেছেন। মাসুদ ভাই বাবার দায়িত্বই পালন করে আসছিলেন। এখন আমরা সবই হারালাম।’
মা মর্জিনা বেওয়া ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শয্যাশায়ী। তিনি শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণ কাঁদছেন। ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে বলেন, ‘এক দিন আগেও বেটার সাথে কথা হইছিল। কেমন আছে জানতে চাইলে বলিছিল, “এখন ভালো, খুব একটা ডিউটি করতে হচ্ছে না।” বেটা আরও বলিছিল, “মা তোমরা চিন্তা কোরো না। তোমরা ভালো থেকো।”’
নিহত মাসুদ রানার স্ত্রী আসমা উল হুসনা আট বছরের একমাত্র সন্তান মাগফিরাতুল মাওয়াকে বুকে জড়িয়ে নির্বাক বসে আছেন। হঠাৎ স্বামীর এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তিনি। সন্তান ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করছিলেন তিনি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, মাসুদ রানা ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। গত ৭ নভেম্বর শান্তি মিশনে রওনা দেওয়ার আগ পর্যন্ত যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। একমাত্র মেয়ে সেখানকার একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে প্রথম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। মিশনে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে লালপুরে মাসহ স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছিলেন। এ সময় চাচা ও ভাইদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দোয়া চেয়েছিলেন। মাকে দেখে রাখার অনুরোধ করেছিলেন।
মাসুদ রানার ছোট চাচা নাহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসুদের বাপ আমার বড় ছিলেন। সে বহু কষ্টে ছেলেদের মানুষ করেছে। বড় ছ্যালি হিসেবে মাসুদও ওর ভাই–বোনদের জন্য অনেক করিছে। এখন সংসারে সুখ হইছে। তাঁর চলে যাওয়াতে শুধু আমরা না, পাড়ার সবাই দুঃখ পাইছে। কারণ ছেলেটা খুব সহজ–সরল ছিল। সবাইকে ভালোবাসত।’
লালপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুলহাস হোসেন জানান, মাসুদ রানার খবর জানার পরপরই প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তাঁর মা, স্ত্রী সন্তানদের পাশে থাকবে প্রশাসন।