এত প্রকল্প, তবু ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ

যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, ঈদের আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে মহাসড়কে লাখো মানুষের ঢল, মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলসহ নানা কারণে যানজট দেখা দেয়। অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজকেও দুষছেন কেউ কেউ।

গাজীপুরের চন্দ্রা মোড় এলাকায় যানজট। ৮ এপ্রিল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তোলাছবি: প্রথম আলো

ঢাকা থেকে চলাচলের প্রায় সব মহাসড়ক চার লেন হয়েছে। স্বাচ্ছন্দে৵ যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে নির্মিত হয়েছে উড়ালসড়ক ও সার্ভিস লেন। যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা–টাঙ্গাইল ও ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের ১১টি উড়ালসড়ক। বিআরটি প্রকল্পের কাজও শেষের দিকে। এ ছাড়া ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে ঈদের আগে–পরে ছয় দিন মহাসড়কে ট্রাক, ভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এত উন্নয়ন প্রকল্প ও সিদ্ধান্তের পরও এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে। যাত্রার শুরুটা স্বস্তিদায়ক হলেও শেষ দুই দিন ছিল চরম দুর্ভোগের।

আরও পড়ুন

ঈদে সড়কে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ঈদে একসঙ্গে অনেক মানুষ গ্রামে যান। তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দূরপাল্লার শত শত যানবাহনের পাশাপাশি পুরোনো বাস মেরামত করে সড়কে নামানো হয়। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ও মহাসড়কে যানবাহন বিকল হয়ে যাওয়ায় যানজটসহ নানা সংকট দেখা দেয়। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, ঈদের আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে মহাসড়কে লাখো মানুষের ঢল, মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচলসহ নানা কারণে যানজট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজকেও দুষছেন কেউ কেউ।

গাজীপুর সড়ক ও পরিবহন চালক সমিতির সভাপতি সুলতান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক উন্নয়নে অনেক কাজ হলেও গাজীপুরে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় ভুল বিআরটি প্রকল্প। এর কারণে ফুটপাত কমে যাওয়ায় মানুষ সড়কে নেমে যাচ্ছে। কাজ বাকি থাকায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ জন্য ঈদের সময় কিছু পয়েন্টে যানজট তৈরি হচ্ছে।

হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৪ এপ্রিল থেকে ঈদযাত্রা শুরু হয়। প্রথমে মহাসড়কে যানবাহন বাড়তে থাকলেও যাত্রা ছিল স্বস্তিদায়ক। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও আশপাশের শিল্পকারখানাগুলো ৬ এপ্রিল থেকে বেতন দিতে শুরু করলে ৭ এপ্রিল থেকে মহাসড়কে যানবাহনের ব্যাপক চাপ দেখা যায়। ওই দিনের পর মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট শুরু হয়।

আরও পড়ুন

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় প্রতিবছর দুই ঈদে ব্যাপক যানজট তৈরি হতো। যানজট নিরসনে সেখানে উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়। এরপর যানজট অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু উড়ালসড়ক নির্মাণের কারণে পশ্চিমে ভাতারিয়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে জায়গা সংকুচিত হয়ে কয়েক বছর ধরে ঈদের সময় যানজট হয়। কখনো কখনো যানজট চার–পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। সেখানে সড়ক প্রশস্ত না করে কিছুদিন আগে একটি সড়ক বিভাজক বানিয়ে সাব লেন তৈরি করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। চন্দ্রায় যাত্রী ওঠানামা করানো উত্তরবঙ্গগামী গাড়িগুলোর ওই লেন ব্যবহারের কথা থাকলেও বেশির ভাগই সামনে সরাসরি লেনে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো করছে। এতে যান চলাচলে ধীরগতি তৈরি হচ্ছে।

চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় একটি বাসের তত্ত্বাবধায়ক আসলাম মিয়া বলেন, চন্দ্রায় উড়ালসড়কের পশ্চিমে ভাতারিয়ায় সড়কের মাথায় আগে সামান্য যানজট হতো। এখন সড়ক বিভাজকের কারণে উত্তরবঙ্গের বাসগুলো সরাসরি লেনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো করায় যানজট হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা উড়ালসড়কের পর সড়ক বিভাজকের কিছু অংশ ফাঁকা রাখার দাবি করেছিলাম, যাতে যাত্রী ওঠানামার জন্য বাস বাঁয়ে লেনে আসতে পারে। কিন্তু সওজ আমাদের কথা শোনেনি।’

আরও পড়ুন

সরেজমিন ঈদের আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে জৈনাবাজার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটারে ১৪টি পয়েন্টে যানজট দেখা গেছে। ঢাকা থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে গাড়িগুলো জয়দেবপুর চৌরাস্তায় যায়। এরপর সালনা, রাজেন্দ্রপুর, হোতাপাড়া, ভবানীপুর, মেম্বারবাড়ি, বাঘের বাজার, গড়গড়িয়া নতুনবাজার, গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি, ১ নম্বর সিঅ্যান্ডবি বাজার, আনসার রোড, মাওনা চৌরাস্তা, অবদার মোড়, এমসি বাজার, নয়নপুর বাজার, জৈনাবাজারে যানজট হয়েছে। এ ছাড়া ঈদের আগের দুই দিন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গাবতলী থেকে নবীনগর পর্যন্ত হেমায়েতপুর, থানা স্ট্যান্ড, সাভার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর এলাকায় যানজট দেখা গেছে। পরে যানজট কমে গেলেও গাড়ি চলেছে ধীরগতিতে। নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল, শ্রীপুর, চক্রবর্তী, জিরানী এলাকায় একই দৃশ্য দেখা গেছে।

মাওনা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ৪ লেন হয়েছে অনেক আগে। সারা বছর যানজট হয় না। দুই ঈদে কিছু পয়েন্টে যানজট হয়। কারণ, একসঙ্গে অনেক যানবাহন বের হওয়ায় কোথাও না কোথাও ছোটখাটো ঝামেলা হয়।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায়। ৯ এপ্রিল সকালে
ছবি: প্রথম আলো

সার্ভিস লেন ব্যবহারে অনীহা
ঢাকা–আরিচা ও চন্দ্রা–নবীনগর মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতের পাশাপাশি যাত্রী ওঠানামা ও স্থানীয় যান চলাচলের জন্য সার্ভিস লেন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইন না মানায় এর কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো ভোগান্তি বেড়েছে। মহাসড়কে যানজটসহ দুর্ভোগের অন্যতম কারণ এটি। এ ছাড়া গাবতলী থেকে কালামপুর ও নবীনগর থেকে জিরানী পর্যন্ত এলাকায় সব মিলিয়ে সংযোগ সড়ক আছে অর্ধশতাধিক। এসব সড়কে যেসব অটোরিকশা চলাচল করে, সেগুলো সুযোগ পেলেই মহাসড়কে ঢুকে পড়ে। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে সংযোগ সড়ক দিয়ে চলাচলকারী বাসগুলো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড ছাড়া ওই সব সড়কঘেঁষা মহাসড়কে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করে। অনেক সময় অধিক যাত্রী তুলতে চালকেরা কৌশলে বাস আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে পেছনের বাসগুলোকে সামনে যেতে বাধা দেন। সার্ভিস লেনেও একই কৌশল অবলম্বন করা হয়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ বাস দাঁড় করানোয় যানজট দেখা দেয়।

সাভার হাইওয়ে থানার ওসি আইয়ুব আলী বলেন, নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড ব্যবহার করে যাত্রী ওঠানো–নামানো করলে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়। কিন্তু চালক ও যাত্রীদের অসচেতনতায় সেটা কঠিন হয়ে যায়। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিছু জায়গায় ধীরগতি দেখা দিলেও তেমন কোনো যানজট ছিল না।

আরও পড়ুন

মহাসড়কের ওপর বাস পার্কিং
গুরুত্বপূর্ণ বাসস্ট্যান্ড ও টার্মিনালে অতিরিক্ত জায়গা না থাকায় দূরপাল্লার বাসগুলো ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত কাউন্টার–সংলগ্ন মহাসড়কে দাঁড় করিয়ে রাখতে বাধ্য হন চালকেরা। সারা বছর এ কারণে মহাসড়কে ভোগান্তি কম থাকলেও ঈদের সময় ভোগান্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এবারের ঈদেও ব্যতিক্রম হয়নি। উল্টো দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি লোকাল বাসগুলো মহাসড়কে পার্ক করে ২০–৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট, থেমে থেমে বাস চলাচলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।

নবীনগর দূরপাল্লার বাস টার্মিনালের একাধিক কাউন্টারের ইনচার্জ জানান, টার্মিনালে বিভিন্ন নামে প্রায় ৩০টি বাস কাউন্টার আছে। ঢাকার গাবতলী থেকে ছেড়ে আসার পর এসব কাউন্টার থেকে দৈনিক শতাধিক বাস দক্ষিণবঙ্গের দিকে যায়। কিন্তু টার্মিনালে বাস পার্কিংয়ের সুযোগ নেই। সোহাগ পরিবহনের কাউন্টার ইনচার্জ নাইম খান প্রথম আলোকে বলেন, নবীনগর টার্মিনালে বাস পার্কিংয়ের আলাদা কোনো জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করাতে দূরপাল্লার সব বাস মহাসড়কের পাশে এনে রাখতে হয়। ঈদের সময় সমস্যা এড়াতে যাত্রার ১০–১৫ মিনিট আগে বাস আনা হয়।

আরও পড়ুন

যানবাহন বিকল হয়ে জট
ঢাকা–টাঙ্গাইল মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার সড়ক একমুখী (ওয়ানওয়ে) চলাচলের ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ। গাড়ির চাপ বাড়ার পর উত্তরবঙ্গগামী যানবাহন সেতু অভিমুখে চলার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে সেতু পার হয়ে আসা যানবাহন ভূঞাপুর হয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। এতে সুফলও মিলেছিল। কিন্তু ৮ এপ্রিল রাতে বঙ্গবন্ধু সেতু ও সেতুর পূর্বপ্রান্তে সংযোগ সড়কে অন্তত ১০টি যানবাহন বিকল হয়ে যায়। একদিকে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ ও অন্যদিকে যানবাহন বিকল হয়ে সড়ক বন্ধ হওয়ায় যানজট লেগে যায়। ৯ এপ্রিল ভোরে সেতু থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার যানজট তৈরি। টাঙ্গাইল থেকে ২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শরফুদ্দিন বলেন, রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যান চলাচল করায় এবং সেতুর ওপরসহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন বিকল হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হয়। ঈদের ছুটি শুরুর পর পাঁচ দিনে সেতুসহ মহাসড়কে ৮৬টি যানবাহন বিকল হয়েছে।

আরও পড়ুন

মহাসড়কে ভোগান্তি কমাতে বেশকিছু পদক্ষেপের কথা বলছেন সড়ক শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঈদের দুই দিন আগে ৬০ শতাংশ কারখানার ছুটি হয়। এরপর আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ২১ লাখ শ্রমিক সড়কে চলে আসেন। এত যাত্রীর ওঠানামায় পর্যাপ্ত বাস বা সড়কের পাশে পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা নেই। মূলত মহাসড়কে মানুষের ঢল নামায় যানজট সৃষ্টি হয়।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, চন্দ্রা ক্রসিংয়ে গাজীপুর ও আশুলিয়ার সংযোগস্থল। সেখানকার উড়ালসড়কটি গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইলগামী। যদি উড়ালসড়কের দুটি লুপ থাকত, তাহলে একটি লুপ ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ও আরেকটি ঢাকা থেকে গাজীপুরে নিতে পারলে যানজট অনেক কমে যেত। সওজের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে চন্দ্রাকেন্দ্রিক যানজট থাকবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আরও পড়ুন