চট্টগ্রামের শহর–গ্রামে পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে

নগরে প্রতিবছর পানির স্তর ৬ ফুট করে নামছে। উপজেলায় কমছে ২ ফুট করে। সেচপ্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ছে।

চট্টগ্রাম জেলার মানচিত্র

২০১৪ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল ৯ ফুট। আর ২০২৪ সালে পানির স্থিতিতল নেমেছে ২১ ফুটে। শুধু চন্দনাইশ নয়, চট্টগ্রামের অন্য ১৪ উপজেলায়ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাচ্ছে।

তবে চট্টগ্রাম নগরের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম নগরের ১০টি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল গড়ে ২৪২ ফুট। আর এখন একই এলাকায় পানি পেতে হলে খুঁড়তে হবে ৩১০ ফুট। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে নগরে এলাকাভেদে প্রতিবছর ৬ ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে।

আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, হালিশহর, ফিরিঙ্গিবাজার, বাকলিয়া, পতেঙ্গা, বন্দরসহ বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে বিভিন্ন ধরনের রোগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে শহরে সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে সেচপ্রক্রিয়া ক্রমাগত হুমকির মধ্যে পড়ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোয় প্রতিবছর গড়ে ২ ফুট করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চাষাবাদেও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অকেজো হয়ে গেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের ৯ হাজার ২১৮টি নলকূপ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপজেলাগুলোয় কৃষিকাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও জমির ওপর গড়ে উঠছে অবকাঠামো। ফলে বৃষ্টি ও ব্যবহারের পানি মাটির নিচে যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরেও কংক্রিটের অবকাঠামোতে খোলা জায়গা ঢাকা পড়ছে। আবার ব্যক্তিগতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি তোলা হচ্ছে। এসব কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে।

চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ কুমার পাল ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। চাষাবাদ এবং কলকারখানায় উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে চাপ বাড়ছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলন করতে গিয়ে স্তর নেমে যাচ্ছে।

নগরে স্তর নেমেছে ৬৮ ফুট

চট্টগ্রাম নগরে পানি সরবরাহের দায়িত্বে আছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি বর্তমানে ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে পারে। এর মধ্যে ৩ থেকে ৪ কোটি লিটার পানি গভীর নলকূপ ব্যবহার করে ভূগর্ভ জলাধার থেকে তোলা হয়। বাকি পানি আসে কর্ণফুলী ও হালদা নদী থেকে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে গেলে উৎপাদনে ধস নামে। বর্তমানে গড়ে ৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হচ্ছে।

ওয়াসার তথ্যমতে, ২০১৪ সালে নগরের ১০টি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল গড়ে ২৪২ ফুট। ২০২৪ সালে ওই একই এলাকার স্থিতিতল ৩১০ ফুট। অর্থাৎ এক দশকে ৬৮ ফুট নেমেছে পানির স্তর। নগরের কৈবল্য ধাম এলাকায় ২০১৪ সালে পানির স্তর ছিল ১৬০ ফুট আর ২০২৪ সালে ৩২০ ফুট। ফিরোজ শাহ এলাকায় এক দশক আগে পানির স্তর ছিল ১৫০ ফুট, বর্তমানে ৩১৭ ফুট।

২০১৮ সালে চুয়েটের একদল গবেষক নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিয়ে প্রকল্পভিত্তিক গবেষণা করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ কুমার পাল। ১৯৬৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের তথ্য নিয়ে তাঁরা ওই গবেষণা করেন। গবেষণার বিষয়ে সুদীপ কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, ’৯০-এর দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম নগরে ব্যাপকভাবে নগরায়ণ ঘটে। বিভিন্ন এলাকায় অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। এর সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারও বাড়তে থাকে। বর্তমানে এলাকাভেদে প্রতিবছর ২ মিটার বা সাড়ে ৬ ফুট করে পানির স্তর নিচে নামছে।

চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আয়শা আখতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম নগরের ২২টি ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় বলা হয়, উত্তর পাঠানটুলী, উত্তর আগ্রাবাদ, রামপুরা, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পাঠানটুলী, পশ্চিম মাদারবাড়ী ও পূর্ব মাদারবাড়ী ওয়ার্ডে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত নিম্নমুখী।

জলাধার ভরাট করা ও অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে স্তর নেমে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে নদী, খাল, পুকুর, দিঘিসহ মাটির ওপরের জলাধার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।

চুয়েটের অধ্যাপক আয়শা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত নগরায়ণের ফলে নির্বিচার গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাধার। খাল, পুকুর কিংবা দিঘি হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে সুপেয় পানির উৎস ক্রমাগত কমছে। বিপর্যয়ের হাত থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষায় নদী, খাল পুনঃখনন এবং চাষাবাদের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি ধারণ ও ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অকেজো হচ্ছে নলকূপ, উঠছে না পানি

২০১৪ সালে মিরসরাই উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল ছিল গড়ে ১৫ ফুট, এখন পৌঁছেছে ২৩ ফুটে। কোনো কোনো এলাকায় পানির স্থিতিতল আরও নিচে চলে গেছে। যেমন ২০১৪ সালে উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নে স্থিতিতল ছিল ২০ ফুট আর ২০২৪ সালের এপ্রিলে ৪০ ফুট। পানি না পাওয়ায় ২০২১ সালের ৩০ মে বিক্ষোভ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

অধিদপ্তরের মিরসরাই কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী কে এম সাইদ মাহমুদ প্রথম আলোকে জানান, গত দুই দশকে অন্তত এক হাজার অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। এসব নলকূপে গড় গভীরতা ২০০ থেকে ২৫০ ফুট। এখন কোনো পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

সীতাকুণ্ড উপজেলায় ১০ বছরের ব্যবধানে পানির স্তর ১৫ ফুটের মতো নেমেছে। এখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় চার হাজার নলকূপ রয়েছে। অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রাশেদুজ্জামান জানান, ২০১৪ সালে পানির স্তর ছিল গড়ে ১৫ ফুট। ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ৩০ ফুটে। পাঁচ শতাধিক অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমেও পানি ওঠে না এসব নলকূপে।

চট্টগ্রামের অন্য সব উপজেলার চিত্রও প্রায় একই রকম। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথি অনুযায়ী, গত এক দশকে সাতকানিয়ায় ১ হাজার ৩৩৪টি অগভীর নলকূপ (গভীরতা ৬১ মিটারের কম) অকেজো হয়েছে। এ ছাড়া লোহাগাড়ায় ৪০৪টি, বাঁশখালীতে ১৪৯, আনোয়ারায় ৯২১, বোয়ালখালীতে ৯৬, পটিয়ায় ৭০০, সন্দ্বীপে ১ হাজার ৭১৮, রাঙ্গুনিয়ায় ১৪৩, ফটিকছড়িতে ২০০ নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, ক্রমাগত পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জেলার অন্তত ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল ও তাঁর দল হালিশহর ও আনোয়ারায় ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা নিয়ে ২০১৭ সালে গবেষণা করেন। অলক পাল প্রথম আলোকে বলেন, হালিশহর ও আনোয়ারার অনেক এলাকায় ৩০০ ফুট গভীরতায়ও পানি পাওয়া যায়নি। আবার যেসব এলাকায় পানি পাওয়া গেছে, তা-ও লবণাক্ত। এ কারণে অসংখ্য মানুষ সুপেয় পানির চরম সংকটে রয়েছে।