নদের ভাঙনে নিঃস্ব তাঁরা

কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বসতভিটা। গত শুক্রবার সকালে কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নদীভাঙন শুরু হয় আরও আগে। তবে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সবকিছুই তছনছ হয়ে যায়। এর পর থেকে ১০ বার বসতবাড়ি সরাতে হয়েছে। এখন ভাঙলে আর সরানোর মতো জায়গাটুকুও নেই। তখন এলাকা ছাড়তে হবে।

শেষ বিকেলে কপোতাক্ষের পাড়ে বসে নদের দিকে তাকিয়ে নদভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের আফছার মোড়ল (৮০) এভাবে নিজের দুর্ভোগের কথা বলছিলেন। হাতের ইশারায় দেখাচ্ছিলেন নদের ওপারের চরে এখন তাঁদের বসতভিটা ও ফসলি জমি জেগে উঠেছে। গত ১৩ বছরে নদের ওপারের চরের প্রস্থ যত বেড়েছে, ততই তাঁদের গ্রামটি সরে গেছে। সরতে সরতে এখন আর কারও নিজের জমিতে দাঁড়ানোর মতো জায়গাটুকু নেই।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামটি কপোতাক্ষের ভাঙনে এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। একই অবস্থা কয়রার দশহালিয়া, গোবরা, ঘাটাখালী, হরিণখোলা ও মদিনাবাদ গ্রামের। গত ১৪ বছরে এসব গ্রামের সাত শতাধিক পরিবারের বসতভিটা ও প্রায় দুই হাজার বিঘা ফসলি জমি নদে বিলীন হয়েছে। আগে মূল গ্রামটি যেখানে ছিল, সেখানে এখন প্রবাহিত হচ্ছে নদ। কিছু অংশে চর জাগলেও তা নদের ওপারের বাসিন্দাদের দখলে চলে গেছে।

কপোতাক্ষ নদের পূর্ব পাড়ে খুলনার কয়রা উপজেলা আর পশ্চিম পাড়ে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা। এই কারণে সীমানা জটিলতায় চাইলেও দখল পাচ্ছেন না চরে জেগে ওঠা জমির মূল মালিকেরা।

কয়রার দশহালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ আফছার মোড়ল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছিলেন, ‘আমার জীবন তো শেষের পথে। যাওয়ার আগে সন্তান ও নাতি-পুতিদের মাথা গোঁজার মতো ব্যবস্থা রেখে যেতে পারলে শান্তি পেতাম। কিন্তু নদের ভাব বোঝা মুশকিল। আমার ৮০ বছরের জীবনে এ নদের ভাব বুঝতে পারলাম না আজও।’

প্রায় ২০ বিঘা ফসলি জমি ও ৫ বিঘা বসতভিটার সবটুকুই নদের ভাঙনে হারিয়েছেন এই বৃদ্ধ। এখন যে জায়গার ওপর ঘর তুলে বাস করছেন, তা অন্যের কাছ থেকে কেনা সম্পত্তি। ভাঙনে সেটুকুও যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

দশহালিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আলীম জানান, কপোতাক্ষের ভাঙনে তাঁর পরিবারের ৫০ বিঘা ফসলি জমির মধ্যে মাত্র এক বিঘা অবশিষ্ট আছে। সেখানে ঘর তুলে বাস করছেন তাঁরা। এখন সেটুকুও যাওয়ার পথে।

কপোতাক্ষের পাড়ের হরিণখোলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের ওপর বসে নদের দিকে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ মর্জিনা বেগম। কাছে যেতেই হাত দিয়ে নদের মাঝখানে কোথায় তাঁদের ঘর ও পূর্বপুরুষদের কবরস্থান, তা দেখালেন।

কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কয়রার দশহালিয়া, গোবরা, ঘাটাখালী, হরিণখোলা ও মদিনাবাদ গ্রামের ময়নুদ্দীন মোল্যা, আমীর আলী, আয়নুদ্দীন, দীনবন্ধু, বসন্ত কুমার জানান, ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে গ্রামের গৃহস্থ পরিবারগুলোরও। কপোতাক্ষের অব্যাহত ভাঙনে তাঁদের ধানের জমি, ঘরবাড়ি, মসজিদ, মন্দির সব চলে গেছে নদের গর্ভে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। আর যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা ভাঙনকবলিত এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।

কপোতাক্ষের তীরের মদিনাবাদ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘১০ বছর ধরে দেখছি, বর্ষাকাল এরে ভাঙন ঠেকানোর কাজের তোড়জোড় শুরু হয়। তখন বালুর বস্তা নিয়ে হাজির হন পাউবোর লোকজন। কাজের তদারকিরও কেউ থাকেন না। এভাবে প্রতিবছর যেনতেনভাবে দায়সারা কাজ চলে। কাজ শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হয় ভাঙন। পরিকল্পনামাফিক কাজ না হওয়ার ফল ভোগ করতে হয়েছে গ্রামের মানুষদের। এখন গ্রামের প্রায় সব মানুষ নিঃস্ব।’

খুলনা পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মুহম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘তিন দিকে নদ-নদীবেষ্টিত কয়রা উপজেলার মূল সমস্যা নদভাঙন। যেকোনো দুর্যোগে নদে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও ভাঙন দেখা দেয় অথবা বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। কয়রার এসব বেড়িবাঁধ এত দিন সাতক্ষীরা পাউবোর আওতাধীন ছিল। এখন আমরা (খুলনা পাউবো) দায়িত্ব পেয়েই নদী-তীরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে ভাঙন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছি।’