ডিজিটালের যুগেও উড়িরচরে খবর পৌঁছায় ‘এলান’ মাইকে
বাজারের দুই প্রান্তে দুটি খুঁটিতে টাঙানো রয়েছে মাইক। কিছুক্ষণ পরপর মাইকগুলো বেজে উঠছে। এলাকায় পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রলার কখন আসবে, বাজারে হুট করে কী পণ্য বিক্রি হচ্ছে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের বার্তাসহ নানা খবর বলা হচ্ছে সেই মাইকে। সম্প্রতি এমন দৃশ্য দেখা গেল চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উড়িরচরের জনতা বাজারে।
যে মাইক দুটি থেকে এসব ঘোষণা দেওয়া হয়, তা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত ‘এলান’ মাইক নামে। দেশে ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারে তথ্যের আদান-প্রদান যখন সহজ হয়ে উঠেছে, তখনো খবর পেতে এ ধরনের এলান মাইকই অন্যতম ভরসা উড়িরচরের বাসিন্দাদের।
উড়িরচরের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরবালুয়া গ্রামের। উড়িরচর ও চরবালুয়া এলাকায় সাতটি বাজার রয়েছে। এর মধ্যে চারটিতেই রয়েছে এলান মাইক। এসব বাজার হলো জনতা বাজার, বাতানি বাজার, বাংলা বাজার ও কলোনি বাজার।
সরেজমিনে দেখা যায়, জনতা বাজারের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে খুঁটিতে মাইক বাঁধা রয়েছে। সেখানে গিয়ে বাসিন্দাদের অনেকে টাকার বিনিময়ে প্রয়োজনীয় ঘোষণা দেওয়াচ্ছেন। মাইকে ঘোষণা দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করছেন। যে ঘোষণা পাঠ করতে হবে প্রথমে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি মাইকে সে ঘোষণা পাঠ করেন। বাঁশটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে ঘোষণাটি ছড়িয়ে দেন তিনি।
আমাদের এখানে ডিজিটাল প্রচারণার ওপর মানুষের ভরসা নেই। এলাকার প্রয়োজনীয় খবর ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে পেলেও মানুষ মাইকে ঘোষণার অপেক্ষায় থাকেন। মাইকে ঘোষণা দিলেই বেশি বিশ্বাস করেন।মো. রুবেল, ঘোষক
বাজারের পূর্ব পাশে যাঁকে ঘোষণা দিতে দেখা যায়, তাঁর নাম মো. রুবেল। তিনি জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে এলাকায় মাইকিং করে আসছেন তাঁর বাবা মো. শহিদুল্লাহ। বাবার অনুপস্থিতিতে তিনিই ঘোষণা পাঠ করেন। প্রতিটি ঘোষণার জন্য আগে মানুষের কাছে ৫ থেকে ১০ টাকা নেওয়া হতো। এখন ঘোষণা পাঠের সময় বিবেচনায় ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। তাঁদের মাইকটি থেকে যেসব ঘোষণা পাঠ করা হয়, তা তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পৌঁছায়।
রুবেল বলেন, ‘আমাদের এখানে ডিজিটাল প্রচারণার ওপর মানুষের ভরসা নেই। এলাকার প্রয়োজনীয় খবর ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে পেলেও মানুষ মাইকে ঘোষণার অপেক্ষায় থাকেন। মাইকে ঘোষণা দিলেই বেশি বিশ্বাস করেন।’
জনতা বাজারের পশ্চিম পাশে যে মাইক রয়েছে, তা স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছর আগে তাঁর মাইকটি কেনা হয়েছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০টি ঘোষণা পাঠ করেন তিনি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে উড়িরচরে যেতে হয় কাঠের ট্রলারে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে প্রতিদিন দুটি ট্রলার চলাচল করে। এর একটির মাঝি মো. বাবুল। তিনি প্রথম আলোকে জানান, জোয়ারের সময়সূচি অনুযায়ী তাঁরা উড়িরচরে ট্রলার নিয়ে যান। তাই প্রতিদিন ট্রলার ছাড়ার ও পৌঁছানোর সময় উড়িরচরের এলান মাইকগুলোতে জানানো হয়। ঘোষণা পাঠের জন্য প্রতি মাসে বাজারের ‘মাইকম্যানদের’ ৬০০ টাকা করে দেন।
জনতা বাজারের কাপড়ের দোকানি কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পুরো গ্রামের মানুষের কাছে তথ্যের জন্য ভরসা এলান মাইক। সরকারি কোনো বার্তা, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতাসংকেত—সবকিছুই বাজারের মাইক থেকে বাদশাহি এলানের মতো প্রচার হয়। বাজারে হুট করে কেউ মাছ-মাংস বিক্রির জন্য নিয়ে এলে সেটিও মাইকের মাধ্যমে প্রচার করেন বিক্রেতারা।
উড়িরচর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. মানিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন আয়তনে বড়, কিন্তু বসতি কম। তাই সবার কাছে কোনো খবর পৌঁছানো বেশ কষ্টকর ছিল। আশির দশকের শেষ দিকে এলাকায় মাইক আসে। তখন থেকে মাইকে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়।’
মো. মানিক আরও বলেন, ‘এলান মাইকের খবরে মানুষের আস্থা জমে গেছে। তাই ডিজিটাল যুগেও মানুষ মাইকের ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করে। আমরাও ইউনিয়ন পরিষদে চাল বিতরণসহ নানা সেবার বিষয়ে এসব মাইকে ঘোষণা দিয়ে বাসিন্দাদের তথ্য জানাই।’