খাগড়াছড়ি
ক্যানসার রোগীর সংখ্যা অজানা, নেই চিকিৎসাও
প্রতিবছরই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে চিকিৎসাসুবিধা না থাকায় দরিদ্র রোগীরা অনেকটা বিনা চিকিৎসায় থাকছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা খাগড়াছড়িতে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই সিভিল সার্জন কার্যালয়ের। এখানকার কোনো হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসাও নেই। আর্থিকভাবে সচ্ছল রোগীরা জেলার বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারলেও দরিদ্র রোগীদের প্রায় বিনা চিকিৎসায় থাকতে হচ্ছে।
জেলায় ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা কত হতে পারে, এ সম্পর্কে ধারণা পেতে প্রথম আলো খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলার জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়িতে ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে ৩৫৬ জনের। ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, প্রতিবছরই ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শনাক্তে দেরি, চিকিৎসায় নিঃস্ব
জেলার পানছড়ি উপজেলার কামিনী মেম্বারপাড়ার গৃহিণী কণিকা চাকমা। তিন বছর ধরে তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, অনেক দিন ধরে অসুস্থ বোধ করছিলেন। পানছড়ি ও খাগড়াছড়িতে চিকিৎসক দেখিয়ে কিছু শনাক্ত হয়নি। পরে চট্টগ্রামে গিয়ে চিকিৎসক দেখালে তাঁর স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়। কণিকা বলেন, তাঁদের কোনো জমানো টাকা ছিল না। তিনটি গরু ও সাতটি ছাগল বিক্রি করে এবং বাড়ির ভিটা বন্ধক রেখে যে টাকা পান, সেটা দিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করান। টাকা নেই বলে এখন চিকিৎসাও বন্ধ তাঁর।
চার বছর ধরে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি এলাকার কৃষক মো. আবদুল করিম। তিনি বলেন, এক একর চাষের জমি ও তিন একর সেগুনবাগান বিক্রি করে কুমিল্লা ও ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর চিকিৎসা করাতে গিয়ে টাকার অভাবে তিন সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ আছে তিন বছর ধরে। এখন বড় দুই ছেলে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন।
ক্যানসার রোগীর সংখ্যা কত
জেলায় ক্যানসার রোগীর সংখ্যা কত, তা জানতে প্রথম আলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে যায়। এখানে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নিলেও ক্যানসার রোগীর সংখ্যা জানাতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সিভিল সার্জন কার্যালয়েও কোনো তালিকা বা ক্যানসার রোগীর সংখ্যা পাওয়া যায়নি। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও এমন কোনো তথ্য নেই।
প্রথম আলো জেলায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানতে ৪ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৩ জন উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ১ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২১ জন চেয়ারম্যান, ২৭ জন ইউপি সদস্য, হেডম্যান, পাড়া কার্বারি ও কয়েকজন শিক্ষকের কাছ থেকে তথ্য নেয়। সেই হিসাবে বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ক্যানসার শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৩৫৬। সাল হিসাবে ক্যানসার শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২০১৯ সালে ৪৯, ২০২০ সালে ৫৩, ২০২১ সালে ৬৯, ২০২২ সালে ৭৯ ও ২০২৩ সালে ১০৬।
উপজেলাভিত্তিক এই হিসাব খাগড়াছড়ি সদরে ৫৮ জন, পানছড়িতে ৩৪, মানিকছড়িতে ৪১, গুইমারায় ২৩, রামগড়ে ৫২, মাটিরাঙ্গায় ৬২, মহালছড়িতে ২২, দীঘিনালায় ৪৬ ও লক্ষ্মীছড়িতে ১৮ জন। ক্যানসার শনাক্ত মোট রোগীর বেশির ভাগ (১৮৮ জন) পাহাড়ি। রোগীদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছরের রোগী ৪ জন, ১০ থেকে ৪০ বছরের ১৩ জন। অন্যদের বয়স ৪১–এর ঊর্ধ্বে। এর মধ্যে নারী ১৫২ জন ও পুরুষ ২০৪ জন।
যাঁদের মাধ্যমে প্রথম আলো ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানার চেষ্টা করেছে, তাঁরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশি হবে। স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য, গত চার বছরে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন ২০০ জনের বেশি।
সার্বিক বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ছাবের বলেন, খাগড়াছড়িতে ক্যানসারের চিকিৎসা করার মতো বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক নেই। যাঁরা আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল, তাঁরা জেলার বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করান। ফলে জেলার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর কোনো তালিকা তাঁদের কাছে নেই।
ক্যানসার হাসপাতালের দাবি
খাগড়াছড়ি শহরের শেফালি ত্রিপুরা ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, অসুস্থ বোধ করলে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁর ক্যানসার শনাক্ত হয়। ওই হাসপাতালে ছয় মাস চিকিৎসা নেন তিনি। পরে ভারতের চেন্নাইয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। চিকিৎসার জন্য প্রায় এক বছর ভারতে ছিলেন তিনি। এখনো তাঁকে ছয় মাস পরপর ঢাকায় গিয়ে থেরাপি দিতে হয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল বলে তিনি এখনো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন। তবে যাঁদের আর্থিক সংগতি নেই, তাঁদের বিনা চিকিৎসায় মরা ছাড়া বিকল্প থাকে না। এই অসহায় মানুষদের কথা ভেবে পাহাড়ে ক্যানসারবিশেষজ্ঞ ও ক্যানসার হাসপাতাল থাকা দরকার।
একটি ক্যানসার হাসপাতালের দাবি জানালেন স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাও। তিনি বলেন, পাহাড়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে খাগড়াছড়িতে একটি ক্যানসার হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন।
খাগড়াছড়িতে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে একটি হাসপাতাল হলে পাশের দুই জেলা রাঙামাটি ও বান্দরবানের মানুষেরাও উপকৃত হবেন।