লবণ চা দিয়ে দিন শুরু করেন তাঁরা

সকালে লবণ চা পান করছেন পাহান পরিবারের সদস্যরা। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বেনুপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

রান্নাঘরে চুলায় হাঁড়িতে টগবগ করছে গরম পানি। সেই পানিতে লবণ ছিটিয়ে দিলেন গৃহিণী বুধি পাহান (৫৬)। এরপর পানিতে চা–পাতা মিশিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে থাকেন।

চুলার পাশে বসে আছেন বুধি পাহানের স্বামী, তিন ছেলে, শিশু নাতি ও ভাতিজা। বাড়ির বাইরে প্রতিবেশী পাঁচ থেকে ছয়জন যুবক। খবর পেয়ে তাঁরাও বাড়িতে চুলার চারপাশ ঘিরে বসলেন।

চুলার পাশে সাজানো মগ ও গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা গরম চা ঢালছেন বুধি পাহান। গরম চায়ে দিলেন চালভাজা। সবাই একে একে গ্লাস হাতে নিয়ে গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর খোশগল্প করছেন।

এমন দৃশ্য দেখা গেল দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ২নং কাটলা ইউনিয়নের বেনুপুর গ্রামের আদিবাসীপাড়ায়। এই পাড়ায় ৩৩টি পরিবারের দেড় শতাধিক মানুষ, সবাই পাহান বংশের। কেউ কেউ এই বংশকে ‘মুন্ডা বংশ’ নামেও জানেন। সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী।

পাড়ার নারী-পুরুষের অধিকাংশই পেশায় কৃষিশ্রমিক। প্রতিদিন সকালে প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরে গরম চায়ের ধোঁয়া ওঠে। গ্লাসভর্তি লবণ চা পান করে গৃহস্থালি ও মাঠের কাজ শুরু করা তাঁদের এক চিরাচরিত ঐতিহ্য।

বুদি পাহান বলেন, ‘হামরা প্রতিদিন সোকাল বেলা নুন চা বানাই। নুন চা দিয়া চাউল ভাজা খাই, পাউরুটি ভিজে খাই। হামার বাড়িয়ালা (স্বামী), ছেলে, নাতি—সব্বাই নুন চা খায়। বাড়ির পুরুষ লোকেরা চা খায়ে মাঠোত কাম করবার যায়। আর হামরা বেঠি ছাওয়ারা (নারী) বাড়িত কামকাজ শুরু করি, কখনো মাঠে কাজে যাই।’

পাহানদের এ লবণ চায়ের আড্ডায় কখনো কখনো যোগ দেন মুসলমান প্রতিবেশীরা। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁদের এমন আড্ডাও কয়েক যুগের। বহু বছর আগে কোনো এক দুর্ভিক্ষের সময় যখন অভাব আর খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তখন ঠান্ডা আবহাওয়ায় শরীরকে উষ্ণ রাখতে ও পেটে বেশিক্ষণ ধরে ক্ষুধার লাগাম টানতেই এ লবণ চা পানের প্রচলন শুরু হয়েছিল—এমনটা জনশ্রুতি আছে এ পাহানপাড়ায়।

পাড়ার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রায় ছয় দশক আগে এখানে চরণ পাহান ও কুমুদ পাহান নামের দুজনের পরিবার বসবাস শুরু করে। পরে আত্মীয়তার সুবাদে ও কৃষিশ্রমিক হিসেবে কয়েকজন নওগাঁ, ধামইরহাট, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি ও দিনাজপুরের ফুলবাড়ি এলাকা থেকে এখানে আসেন। একপর্যায়ে তাঁরাও এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। দুটি পরিবার থেকে এখন সেখানে ৩৩টি পরিবারের বসবাস।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বেনুপুর গ্রামে সকালে লবণ চা পান করতে বাড়ির আঙিনায় অপেক্ষা করছেন পাহান পরিবারের সদস্যরা
ছবি: প্রথম আলো

একসময় এসব খেটে খাওয়া মানুষদের কুঁড়েঘরে অভাব-অনটন ছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় কঠোর পরিশ্রমে সেই অভাব এখন অনেকটাই কম। জীবনমানে এসেছে পরিবর্তন। অক্ষরজ্ঞানহীন পাহান পরিবার থেকে তিনজন স্নাতক পাস করেছেন। গত এক দশকে পাহান পরিবার থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করেছে।

পাড়ায় কারও কারও মাটির ঘর এখন ইটের বাড়ি হয়েছে। তাঁদের দুই-তিনজন দুই-আড়াই বিঘা জমিও কিনেছেন। এ ছাড়া এই পাড়ার অধিকাংশ পরিবারই সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে গরু-ছাগল লালন–পালন করছেন। পাহান পরিবারগুলোয় জীবনযাপন, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে লবণ চায়ের সঙ্গে চালভাজা খাওয়ার ঐতিহ্য। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই লবণ চা পানে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

গ্রামের বাসিন্দা খিষন পাহান (৭৬) বলেন, ‘সোকালে নুন চা না খাইলে ভালো লাগে না। নুন চা খাইলে পেটের ক্ষুধাটা কাটে যায়। তখন মাঠে কাজের মধ্যে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত থাকা যায়। পরে গাও-গোসল করে ভাত খাই।’

গৃহবধূ সম্পা পাহান বলেন, তাঁর বাবার বাড়িতেও লবণ চা পানের প্রচলন আছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেন, এখানেও লবণ চা পান করা হয়। ঠান্ডার সময় লবণ চা পান করলে শরীর গরম থাকে। সংসারের কাজে শক্তি পান।

এই পাড়ায় আড্ডা দিতে আশপাশের শৈলান, বেনীপুর, চকশ্যাম গ্রামের বাসিন্দারাও আসেন। ভালো প্রতিবেশী আর বন্ধুসুলভ আচরণে তাঁদের মধ্যে নেই ধর্মীয় বিভেদ। চকশ্যাম গ্রামের বাসিন্দা হযরত আলী (৪৫) বলেন, ‘আমি ম্যালা দিন থেকে আদিবাসীদের সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজ করি। আদিবাসীরা সকালে নুন চা খায়। আমাকেও চায়ের দাওয়াত দেয়। তাদের সাথে আমিও নুন চা খাই। আমরা দুই ধর্মের হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে।’