নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে অনবরত গোলাগুলি, এপারে নির্ঘুম রাত

আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। ফাঁকা পড়ে আছে সড়ক ও বাজার। আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বেতবুনিয়া বাজার এলাকায়ছবি: এস এম হানিফ

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি ঘিরে রাতভর গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে কেঁপে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অন্তত ১৩টি গ্রাম। গতকাল সোমবার রাত ৯টা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত অনবরত গোলাগুলির শব্দে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে এপারের বাসিন্দারা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি। এই চৌকির দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) মধ্যে রোববার রাত ১১টা থেকে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে একটি মর্টার শেল ঘুমধুমের জলপাইতলী গ্রামে এসে পড়লে দুজন নিহত হন। এরপর আতঙ্ক বেড়ে যায় সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে।

মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল এসে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের উঠানে। আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়া এলাকায়
ছবি: এস এম হানিফ

আজ মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে কয়েকজন পুরুষ ছাড়া কেউ নেই। নারী-শিশুরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্রে অবস্থান নিয়েছে। ঘরের বাইরে খুব কম মানুষকে দেখা গেছে। মধ্যমপাড়া পাঞ্জেগানা মসজিদে নিয়মিত আজান দেন আবদুস সোবহান (৭০)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনের মতো আজ মঙ্গলবার ভোরে ফজরের আজান হয়। কিন্তু একজন মানুষও নামাজে আসেননি। সবার মধ্যে গোলাবারুদের ভয় কাজ করছে।

ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়–সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ছৈয়দ নুর (৬৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যতটুকু ভয় পাচ্ছে মানুষ, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এত ভয় পায় নাই। ওই সময় মানুষ সামনে থেকে যুদ্ধ করেছে। এখন সংঘর্ষ চলছে ওপারে, আমাদের করার কিছু নেইও। রাতে ঘরে কেউ ছিলেন না। আমি বালুখালী থেকে মাত্র এলাম।’

সোমবার দিবাগত রাতে সংঘর্ষের সময় বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য
ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় লোকজন বলেন, ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলকে ঘিরে রোববার রাত থেকে থেমে থেমে আরকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ চলছে। গতকাল সোমবার দুপুরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে অন্তত পৌনে এক ঘণ্টা গোলাবর্ষণ করে। কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে রাত নয়টা থেকে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। রাতের অন্ধকারে হেলিকপ্টার থেকে গোলা ফেলা হয়, মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে আজ মঙ্গলবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত চলে। সংঘর্ষের গোলাবারুদ এসে পড়ছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। এতে এপারে ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, বেতবুনিয়া বাজার পাড়া, পাশের পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমান পাড়া, বালুখালী, দক্ষিণ বালু খালী এলাকা প্রকম্পিত হয়।

আরও পড়ুন

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার রাত নয়টা থেকে দুই পক্ষের লড়াইয়ের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। এত কম্পন আমরা আর দেখিনি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকাজুড়ে কেঁপে ওঠে। একটি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছেন লোকজন।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাতে সংঘর্ষ চলাকালে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত ছয় সদস্যকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখা গেছে। তাঁদের বালুখালী বিজিবি ক্যাম্প ও ঘুমধুম বিজবি ক্যাম্পে হেফাজতে রাখা হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রাতে নির্ঘুম রাত পার করেছে মানুষ। মর্টার শেলে দুজন নিহত হওয়ার পর আতঙ্ক দ্বিগুণ বেড়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনে কাউকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন