ওরা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর

অন্যের বাড়িতে কাজ আর টিউশনি করে নিজে পড়াশোনা করেছে জাকিয়া। মেহেদী হাসান ধারদেনা করে লেখাপড়া করেছে। সে টাকা এখনো শোধ করতে পারেনি। শ্রাবণীর আশা, সে চিকিৎসক হবে। কিন্তু তার পরিবার থাকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘরে। টাকা কোথায় সে স্বপ্ন পূরণের। আর বাড়িতে কবে মাছ-মাংস রান্না হয়েছে, তা মনে নেই তামান্নার।

কিন্তু পড়াশোনায় দারিদ্র্যের ছাপ পড়তে দেয়নি তারা। এই চার মেধাবী শিক্ষার্থী এবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। খুশির খবরে ওদের ঘরে আনন্দের বদলে এখন দুশ্চিন্তা। ভর্তি ও পড়ার খরচ নিয়ে চিন্তিত তাদের মা-বাবা। তবু শত বাধা ডিঙিয়ে মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর।

ধারদেনা করে পড়েছে মেহেদী

‘ছেলেটার খুব কষ্ট। দিনোত মাইনষের বাড়িত কাম করে, রাইত জাগি পড়া পড়ে। এল্যা পাড়ার মানুষ কয় তোমার ব্যাটাটা তো সোনা। শুনি মোর বুকটা ফাটি যাওচে। কিন্তুক মুইতো হনু গরিব মানুষ। একদিন কামোত না গেইলে প্যাটোত ভাত যায় না। ছেলেটাক ফির কলেজোত পড়ামো কোনটে থাকি।’

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের উত্তর নারায়ণজন গ্রামের মনোয়ারা বেগমের দুঃখের সংসারে আনন্দের বার্তা এনেছে ছেলে মেহেদী হাসান সরকার। সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় বরাতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে মেহেদী সবার ছোট।

মেহেদীর বাবা নাজমুল ইসলাম আগে দিনমজুরি করতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ভারী কাজ করতে পারেন না। তিনি এখন গ্রামের শিশুদের আরবি পড়ান। এতে মাসে তিন হাজার টাকা পান। মা মনোয়ারা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে যে ১০০-১৫০ টাকা আয় করেন, তা দিয়ে ঠিকমতো দুইবেলা খাবার জোটে না।

উপহারের ঘরে থাকে শ্রাবণীরা

শ্রাবণী রানী মাহাতো সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধুবিল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম শ্যামেরঘোন এলাকার কৃষক বাবুল চন্দ্র মাহাতো ও গৃহিণী বিজলী রানী মাহাতো দম্পতির সন্তান। তাড়াশ উপজেলার বিষমডাঙা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ-৫ (বিজ্ঞান বিভাগ) পেয়েছে সে। পড়ালেখা করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তার। শ্রাবণী বলে, আগে তাদের ঘরও ছিল না। ঘরের অভাব দূর হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছে। কেউ যদি তার পড়াশোনায় সহায়তা করে, তাহলেই তার পক্ষে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানুষের জন্য আমরার সাধারণ সম্পাদক ও নিমগাছি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক যোগেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, মেধাবী মেয়েটির পড়ালেখার প্রতি খুব আগ্রহ। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সংগতি না থাকায় বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়েছে।

তামান্নার পড়াশোনা এখনো অনিশ্চিত

তামান্না আক্তার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ নাজির উদ্দিন পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর বাবা জালাল শেখের মেয়ে। বাবা শাক বিক্রি করে কোনোভাবে সংসার সামাল দিচ্ছেন।

৪ শতাংশ জমির ওপর একটি চৌচালা টিনের ঘর তামান্নাদের। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বারান্দায় বাবা জালাল শেখ বসে আছেন। উঠানের এক পাশে রান্না করছেন তামান্নার মা মনোয়ারা বেগম। জালাল বলেন, স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলেসহ পাঁচ সদস্যের সংসার। মাঠে অন্যের ১৬ শতাংশ জমিতে কলমি, লাল ও পুঁইশাকের আবাদ করেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিম মুন্সী প্রায় দেড় বছর প্রতি মাসে তামান্নাকে এক হাজার টাকা দিতেন। তাঁর প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ।

তামান্না বলে, এক কোচিং সেন্টারে বিজ্ঞানের চার বিষয়ে অন্যের থেকে অর্ধেক বেতনে পড়েছি। বাকি সব বিষয় নিজেই পড়েছি। প্রতিদিন রাত ১০-১১টা পর্যন্ত পড়ে ঘুমাতাম। রাত তিনটা থেকে আবার পড়া শুরু করতাম। সকালে মাঠে শাক তুলতে যাই বাবার সঙ্গে। এবার ফরিদপুর কলেজে ভর্তি হতে চাচ্ছি। কিন্তু কীভাবে হব, জানি না।’

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন জাকিয়ার

জাকিয়া সুলতানা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর আশালতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। নুরনগর গ্রামে বসতভিটাসহ মাত্র সাত শতক জমির মালিক রিকশাচালক বাবা জামাল হোসেন। অভাবের কারণে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের পরপরই জাকিয়ার লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। ক্লাসের রোল এক হওয়ায় তার পাশে দাঁড়ান বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা। মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীর বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ আর প্রাথমিকের তিন শিশুকে প্রাইভেট পড়িয়ে সে নিজের লেখাপাড়ার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করে নেয়।

জাকিয়া জানায়, পরিবারের সংগতি না থাকার পরও বাবা-মায়ের উৎসাহ ও নিজের চেষ্টায় এসএসসি পর্যন্ত পৌঁছেছে। দিনে গৃহকর্মীর কাজ ও প্রাইভেটের জন্য বেশি সময় চলে গেলেও বিদ্যালয়ে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা ছিল তার। ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

শ্যামনগর নুরনগর আশালতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওবায়দুর রহমান জানান, মেধাবী জাকিয়াকে নবম শ্রেণি থেকে বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। সচ্ছল ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের সামান্য সহযোগিতা পেলে জাকিয়া তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা; রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর; এম রাশেদুল হক, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী ও সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]