‘আসেন ভাইজান, শরিক হয়ে যান’

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে একসঙ্গে ইফতার করছেন হাজারো মানুষ। গতকাল বিকেলেছবি: প্রথম আলো

আন্দরকিল্লার শাহি জামে মসজিদের গণ–ইফতার আয়োজনে গত বছর আবুল কালামকে দেখেছিলাম। ষাটের কোঠায় বয়স, মানুষটির দিলখোলা হাসি এখনো চোখে লেগে আছে। এবার মসজিদে এসেই দেখলাম ইফতার আয়োজন পুরোদমে শুরু হয়েছে। করিতকর্মা লোকজনের ভিড়ে আমার চোখ খুঁজছে আবুল কালামকে। মসজিদের একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে তো মারা গেছে।’ বুকটা ধক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের আরেকজন চেঁচিয়ে বললেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ। এইটা সেই কালাম না। কালাম তো আছে, ওই যে।’

স্বস্তি নিয়ে কাছে যেতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। প্রতিবারের মতো এবারও পয়লা রমজানে চলে এসেছেন মসজিদে। ঈদ পর্যন্ত এখানেই থাকবেন। ২০ বছর ধরে মানুষের পাতে ইফতারি বেড়ে দিচ্ছেন। এতেই তাঁর তৃপ্তি। কালাম হেসে বললেন, ‘আসেন ভাইজান, শরিক হয়ে যান।’

গতকাল রোববার বিকেলে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার শাহি জামে মসজিদে গণ–ইফতারে শামিল হয়েছিলেন প্রায় তিন হাজার রোজাদার। গত বছরের তুলনায় এবার লোক দ্বিগুণ হচ্ছে। ২৪ বছর ধরে দিল্লির জামে মসজিদের আদলে তৈরি এই মসজিদে এমন আয়োজন হচ্ছে।

খোলা বড় চত্বর আর জাফরিকাটা খিলানের সাবেকি মসজিদে পা দিতেই মন শান্ত হয়ে আসে। বিকেল চারটায় আমরা যখন সেখানে যাই, তখন প্লেটে প্লেটে ইফতারি পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক। তবে ইফতারি তৈরির কাজ শুরু হয় সেই সকাল আটটায়। আটজন বাবুর্চি ছোলা, পাকোড়া, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, চপ আর চিড়া তৈরির কাজ শুরু করেন। বড় তিন ডেক আর তিনটি কড়াইয়ে রান্নার আয়োজন চলেছে দুপুর পর্যন্ত।

মসজিদের এক কোণে প্রতিবছরের মতো এবারও বড় ড্রামে শরবত তৈরি করছিলেন মো. শহীদ আলম। এক ব্যবসায়ীর কর্মচারী তিনি। তিনি বললেন, এবার দৈনিক আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষের জন্য রুহআফজার শরবত তৈরি করছেন তিনি।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মসজিদ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রিকশাচালক-কে নেই এই গণ–ইফতার আয়োজনে। মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদ এই আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। তিনি জানান, এ বছর ইফতার আয়োজনে লোক যেমন বেড়েছে, তেমনি সহায়তার পরিমাণও বেড়েছে। এক ব্যবসায়ী এখানকার ১৫ দিনের ইফতার আয়োজনের সামগ্রী পাঠাচ্ছেন। তবে নাম প্রকাশ করতে চান না তিনি।

আগ্রাবাদ থেকে গণ–ইফতারের আয়োজনে প্রথমবারের মতো এসেছেন গোলাম রসুল (৬০) নামের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী। ইফতারির থালার সামনে বসে তিনি বললেন, ‘নিয়ত করেছিলাম এখানে ইফতার করব। এত মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে আগে কখনো ইফতার করিনি। খুব ভালো লাগছে।’

দস্তরখানায় কাতারে বসে থাকা হাজারো রোজাদারের সামনে ইফতারির থালা। গ্লাসে গ্লাসে শরবতও পেয়েছেন সবাই। আজান পড়তেই সবাই একসঙ্গে খাবার মুখে দিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েক শ মানুষ এসে ঢুকলেন মসজিদ চত্বরে। স্বেচ্ছাসেবকেরা বড় দুটি টেবিলের সামনে ডেকে নিলেন তাঁদের। কেউ বোতল থেকে, আর কেউ গ্লাস থেকে শরবত পান করে রোজা ভাঙলেন। সবার মুখেই তৃপ্তি আর প্রশান্তির ছাপ।