বালু তোলায় ঝুঁকিতে জনপদ 

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কলমু এলাকায়  তিন মাস ধরে বালু তোলা হচ্ছে। বালুবাহী ট্রাক চলায় ওই এলাকার রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। 

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কলমু এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বালু তোলার পর কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছেছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কলমু এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। এতে ওই এলাকায় বর্ষাকালে ভয়াবহ নদীভাঙন শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নদ থেকে তোলার পর বালু কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঘেঁষে রাখা হচ্ছে। বিদ্যালয়ের পাশ থেকে দিনরাত ট্রাক ও ট্রাক্টর দিয়ে বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে ওই বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কাছে দ্রুত বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কামারজানি বাজার। বাজার থেকে ১ কিলোমিটার উত্তরে বেড়িবাঁধ–সংলগ্ন কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৫ সালে সাড়ে পাঁচ শতক জমির ওপর স্থাপিত হয় বিদ্যালয়টি। বর্তমানে এখানে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। 

স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০০ গজ দূরে ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। সেই নদের তলদেশ থেকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত খননযন্ত্র বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। সেই বালু বিদ্যালয় ঘেঁষে রাখা হয়েছে। এখান থেকে ট্রাক ও ট্রাক্টরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। বালু রাখার কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তাটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কলমু এলাকার আসাদুজ্জামান শ্রমিক নিয়োগ করে এভাবে বালু তুলছেন। কিন্তু বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী এভাবে বালু তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০–এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে, ইজারা ব্যতীত কোনো বালুমহাল থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন, পরিবহন, বিপণন ও সরবারহ করা যাবে না এবং এই মর্মে কোনো রাজস্বও আদায় করা যাবে না। একই আইনের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু তোলা যাবে না। 

এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে কলমু এলাকার আসাদুজ্জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রংপুরের পীরগঞ্জ এলাকায় সরকারের নানা উন্নয়নকাজ চলছে। সেখানে স্থানীয় মোটা বালু পাওয়া যায় না। ফলে কলমু এলাকা থেকে বালু তুলে সেখানে পাঠাচ্ছি।’ তিনি দাবি করেন, কয়েক দিন ধরে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। তবে গতকাল ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসাদুজ্জামান বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝখানে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। সেই বালু লম্বা পাইপ দিয়ে বিদ্যালয় ঘেঁষে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। কিছু শ্রমিক ট্রাক্টরে বালু তুলছেন। 

এলাকাবাসী জানান, তিন মাস ধরে প্রতিদিন বালু তোলা হচ্ছে। ২০-২৫টি ট্রাক্টর ও ট্রাক দিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় বালু পাঠানো হচ্ছে। ট্রাক্টরের বিকট শব্দে এলাকাবাসীকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে এক ট্রাক্টর বালু ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বালুবাহী ট্রাক্টর চলাচল করায় রাস্তা নষ্ট হয়েছে। বালু বহনের সুবিধার্থে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েক স্থানে ঢালু করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, বালু তোলার কারণে বর্ষার সময় নদীভাঙন হয়। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রাখা হচ্ছে। এতে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা জানায়, বিদ্যালয়ের সামনে ও পেছনে বালুর স্তূপ। যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একটার পর একটা গাড়ি যাতায়াত করছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। বালুর ব্যবসা বন্ধের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’

কলমু এলাকার কৃষক আজিজুল হক বলেন, কামারজানি নদীভাঙনকবলিত এলাকা। প্রতিবছর বর্ষার সময় নদীতে ভাঙন শুরু হয়। অবৈধভাবে বালু তোলায় কলমু এলাকার সামনে গভীর হয়ে গেছে। বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ভাঙন আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। পাশাপাশি ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।

একই এলাকার সমাজকর্মী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘প্রতি রাতে বালুবাহী ট্রাক্টরের শব্দে কেউ ঘুমাতে পারছেন না। বিষয়টি কামারজানি ইউপি চেয়ারম্যানকে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি।’

এ বিষয়ে কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। 

সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজাউল ইসলাম বলেন, বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।