সেচপাম্প স্থাপনে অনিয়ম

অনৈতিক সুবিধা পেতে কর্মকর্তারা পাম্পমালিকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মুহাম্মদপুর পাগলার মাঠে বিএডিসির লো-লিফট সেচপাম্প। গতকাল দুপুরে।
ছবি: প্রথম আলো

মেহেরপুরের গাংনীতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ‘মুজিবনগর ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে’ সেচপাম্প স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দালাল চক্রের সঙ্গে মিলে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে একই সেচ স্কিমের আওতায় একাধিক সেচপাম্প বরাদ্দের ঘটনা ঘটেছে। এতে করে সেচপাম্পের মালিকেরা প্রতিযোগিতা থেকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিরোধ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে।

গাংনী উপজেলা সেচ ও কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি বিএডিসির কর্মকর্তাদের অনিয়মের ব্যাপারে দুদক প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেছে।

গ্রামের কয়েকজন দালাল সেচপাম্পের জন্য আবেদন করতে আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। পরে আরও কয়েক দফা নগদ টাকা নেন। এখন সেচপাম্প নিয়ে পার্শ্ববর্তী সেচপাম্পের মালিক ওসমানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছে ।
আম্বিয়া খাতুন, সেচপাম্পের মালিক

বিএডিসি ও সেবাগ্রহীতারা জানান, সেচ কার্যক্রমের সমন্বয়, দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা, পানির অপচয় রোধ, সেচ খরচ হ্রাস ও অংশগ্রহণমূলক পানিব্যবস্থা নিশ্চিতে ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে ২০২১ সালে এ সেচ স্কিম চালু হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, একটি সেচপাম্পের সঙ্গে আরেকটির ২৭০০ ফুট (৮২৩ মিটার) দূরত্ব থাকতে হবে। একটি লো-লিফট পাম্পের (এলএলপি) আওতায় সর্বোচ্চ দুই হাজার হেক্টর (১৪ হাজার ৯৪০ বিঘা) আবাদি জমি থাকতে পারে।

উপজেলা বিএডিসি কার্যালয় জানায়, এলএলপি সেচ প্রকল্প নিতে আবেদনকারীকে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। একটি সেচ প্রকল্প নির্মাণে সরকারের ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ পড়ে।

পাম্পমালিকেরা বলছেন, বিএডিসির কর্মকর্তারা সেচপাম্প বরাদ্দের নীতিমালা মানেননি। ২০০ মিটারের মধ্যে একাধিক পাম্প দেওয়া হয়েছে। এতে একেকটি পাম্প ৩০০-৪০০ বিঘা জমিতে সেচ দিতে পারছে না। পাম্পমালিকেরা জানান, মাসে কমপক্ষে ১২০০-১৩০০ বিঘা জমিতে সেচ দিতে পারলে মাসিক বিদ্যুৎ বিল উঠে আসে। কাছাকাছি দূরত্বে একাধিক পাম্প দেওয়ায় বিলের টাকাই উঠছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় গাংনী উপজেলায় ১২টি এলএলপি রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি দেওয়া হয়েছে ৪০০ মিটারেরও কম দূরত্বের মধ্যে। এর মধ্যে মটমুড়া ইউনিয়নের মুহাম্মদপুর গ্রামেই রয়েছে চারটি, যাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। দুজন পাম্পমালিকের দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।

গতকাল শনিবার বিকেলে মুহাম্মদপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাথাভাঙ্গা নদী থেকে পাইপের মাধ্যমে পাম্প দিয়ে টেনে আনা হচ্ছে পানি। সেই পানি জমা হচ্ছে কংক্রিটের ট্যাংকে। ট্যাংক থেকে মাটির নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে অনেক দূর গিয়ে পাকা নালায় পৌঁছেছে। এভাবে ভুট্টা, গম, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু, রসুন, ফুলকপিসহ নানা ফসলের খেতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের পানি। এ গ্রামে পাশাপাশি কয়েকটি পাম্প চোখে পড়ে।

একটি সেচপাম্পের মালিক সাইদুল ইসলাম বলেন, মুহাম্মদপুর পাগলার মাঠে সেচের জন্য তিনি এলএলপি সেচপাম্প পান। এখানে একটি সেচপাম্পই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিএডিসির কর্মকর্তারা গোপনে আরও একজনকে একই স্কিমের আওতায় সেচপাম্প দিয়েছেন। মাত্র ২০০ মিটারের মধ্যে আরও একটি পাম্প স্থাপন করেছে বিএডিসি। এতে বিরোধ তৈরি হয়। মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত হোসেন বলেন, কয়েকজন দালালের যোগসাজশে বিএডিসির কর্মকর্তারা কয়েকজন পাগলার মাঠে সরেজমিন প্রদর্শন করে তাঁকে প্রকল্প নিতে আবেদন করতে বলেন। সেই মতো তাঁকে এলএলপি সেচপাম্প দেন। একই স্কিমের মধ্যে দুটি প্রকল্প হবে, তা তাঁকে জানানো হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।

আরেকটি সেচপাম্পের মালিক আহসান হাবিব বলেন, বিএডিসির কর্মকর্তারা তাঁর সেচপ্রকল্পের নালা তৈরিতে অনিয়ম করেছেন। বেশির ভাগ কংক্রিটের নালার নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। প্রতিবাদ করতে গেলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

বামন্দী ইউনিয়নের ভোলাডাঙ্গা গ্রামের ওসমান আলী ও আম্বিয়া খাতুন পাশাপাশি দুটি পাম্প পেয়েছেন। আম্বিয়া খাতুন বলেন, গ্রামের কয়েকজন দালাল সেচপাম্পের জন্য আবেদন করতে তাঁর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। পরে আরও কয়েক দফা নগদ টাকা নেন। এখন সেচপাম্প নিয়ে পার্শ্ববর্তী সেচপাম্পের মালিক ওসমানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছে।

উপজেলা সেচ ও কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সভাপতি হারুন-অর রশীদ বলেন, মুজিবনগর ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মকর্তারা সেচপাম্পমালিকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে দিয়েছেন। সামান্য অনৈতিক সুবিধা পেতে তাঁরা কাছাকাছি একাধিক সেচপাম্প বসিয়েছেন।

বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ গাংনী কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী শ্যামল হোসেন বলেন, প্রকল্পের আওতায় যেসব এলাকায় নদ-নদী থেকে পানি ব্যবহার করে সেচ–সুবিধা পাওয়া যায়, সেখানে একাধিক এলএলপি স্থাপন করা হয়েছে। যেসব মাঠে সেচের চাহিদা ব্যাপক, সেখানে অতিরিক্ত পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখানে কোনো প্রকার অনিয়ম করা হয়নি।

জানতে চাইলে জেলা বিএডিসির সেচ প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম বলেন, পাঁচজন সেচপাম্পমালিক পাম্প স্থাপনে অনিয়ম হয়েছে, এমন লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। অনিয়মের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।