গফরগাঁওয়ে ‘গলাকাটা’ নামটি যেভাবে এল

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গলাকাটা বাজার
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে মসৃণ পাকা সড়কটি একেবারে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে চলে গেছে টোক পর্যন্ত। দৃষ্টিনন্দন এ সড়কে একটু পরপর চোখে পড়ে বিভিন্ন বাজারের নামে মাইলফলক। চলার পথে চোখ আটকে যায় একটি মাইলফলকে। গফরগাঁও উপজেলা পরিষদ পার হতেই সড়কের পাশে সে মাইলফলকে লেখা ‘গলাকাটা ৬ কিলোমিটার’।

ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা সড়কটি ধরে ছয় কিলোমিটার যাওয়ার পর আবার চোখে পড়ে ‘সামনে গলাকাটা বাজার’। কৌতূহল নিয়ে বাজারে যাওয়ার পর দেখা যায়, সাধারণ একটি বাজার। গ্রামের বাজারে যেমন দোকানপাট থাকে তেমন দোকানপাট সেখানে। সেদিন বাজারের পাশে শাঁখচূড়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠান ছিল। যে কারণে বাজার ছিল জমজমাট।

বাজারের নাম গলাকাটা কেন—এ প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় একাধিক মানুষের সঙ্গে। গলাকাটা বাজারের পাশের দিঘিরপাড় গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী কাঞ্চন মিয়া কিছুটা হিসাব করে বলেন, ‘৫৮ বছর আগের কথা। সে সময় আমিও ছোট। যতটুকু মনে আছে সেটা হচ্ছে, ওই সময় এই বাজারের পাশে স্কুলপড়ুয়া এক শিশুর লাশ পাওয়া গিয়েছিল। শিশুর লাশটি গলাকাটা ছিল। এর পর থেকেই নাকি বাজারের নাম হয়ে যায় গলাকাটা বাজার।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের চর দখল দিয়ে একসময় কয়েক গ্রামের মানুষের মধ্যে মারামারি হতো। মারামারিতে একবার গলা কেটে একজনকে হত্যা করা হয়। সে কারণেই নাকি বাজারের নাম গলাকাটা।

তবে নামকরণের এই দুটি গল্প মোটেও সত্য নয় বলে দাবি করলেন গলাকাটা বাজারের পাশের শাঁখচূড়া গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক ফাইজুস সালেহীন। তিনি স্থানীয় মুসলেহ উদ্দিন ফাউন্ডেশন ও স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি। তাঁর ভাষ্য, এই নামকরণের পেছনে আছে বীরত্বের গল্প। ব্রিটিশ শাসনের সময়ের কথা। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ছিল নীলকুঠি। সেই নীলকুঠির ইংরেজরা সাধারণ মানুষের ওপর অনেক অত্যাচার করত। এতে গ্রামের মানুষ নীলকুঠির ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। একদিন এক ইংরেজ নীলকর সাহেবকে বাজারে গলা কেটে হত্যা করে গ্রামবাসী। এভাবেই বাজারের নাম হয়ে ওঠে গলাকাটা।

ফাইজুস সালেহীনের সূত্র ধরে জানা যায়, মহীউদ্দিন খান রচিত ‘জীবনের খেলাঘরে’ বইয়ে নামকরণের কথা আছে। বইয়ের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে পিতলগঞ্জ নীলকুঠি। সেই নীলকুঠির লাঠিয়ালরা ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে হয়ে গ্রামে হানা দিত। মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে নীলকুঠিতে কাজ করাত। এভাবে চলতে থাকায় ডেঙ্গু খা নামের একজন কুঠির লাঠিয়ালদের বলেছিলেন, গ্রামের মানুষদের আর বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো যাবে না। এ কথা যেন ইংরেজ সাহেবদের বলে দেয়। এ ঘটনায় নীলকুঠির লাঠিয়ালদের সঙ্গে গ্রামবাসীর হানাহানিতে অনেক মানুষ মারা যায়। একদিন গ্রামের লোক দলে বেঁধে নীলকুঠিতে হামলা করে। হামলায় এক ইংরেজ মারা যান। গলা কেটে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল বলে সেই থেকে বাজারের নাম গলাকাটা বাজার হয়ে যায়।

ফাইজুস সালেহীন বলেন, গ্রামের মানুষ নামকরণের ইতিহাসটি জানেন না বলে একেকজন একেকভাবে বলেন। তবে সবারই এই ইতিহাস জানা থাকলে ভালো হতো।